মো. সাহিদ ইসলাম: মানুষ মরণশীল তাই ‘মৃত্যু নিশ্চিত’ এই চিরন্তন সত্যটা মানুষ অস্বীকার করতে না পারলেও কেন যেন বিশ্বাস করতে চান না সহজে! তাই মৃত্যুর জন্য কেউই প্রস্তুত থাকেননা। মানুষের ধারণা সে বেঁচে থাকবে বহু বছর পরেও, তাইতো আজ থেকে অনেক বছর পরেও সবকিছু নিজেই করবে ভেবে বসে থাকেন অনেকেই! এর অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় অনেকেই ভাবেন শুধুমাত্র ব্যাংকের নিয়মের জন্য নমিনি দেওয়া হয়েছে, টাকা তো তিনিই উঠাবেন!
এজন্য কেউ বুঝে নমিনি করে আপনজনকে, আবার কেউবা নমিনি করে অন্য কাউকে। দুঃখজনক সত্যি হলো, অনেকেই নমিনির বিষয় সম্পর্কে না বুঝেই যাকে-তাকে নমিনি করেন। দেখা যায় অনেক সময় রুমমেট, পার্টনার, নাবালক, মা-বাবা, ভাই-বোন ইত্যাদি অনেকেই থাকেন! অনেক সময় দুই স্ত্রীর এক স্ত্রীকে নমিনি করে দেন! আমানতকারী হয়ত না বুঝেই, নিজের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও বিশ্বাস না করে, নিজেই উত্তোলন করবেন ভেবে এইভাবে নমিনি করেন কিন্তু যখন তিনি পটল তুলেন বিপত্তিটা বাধে তখন!
মঞ্জুরুল হক চৌধুরী এবং অন্যান্য বনাম বিলকিস আরা বেগম এবং অন্যান্য মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ‘সঞ্চয়পত্রের অ্যাকাউন্টধারী মারা গেলে ওই সঞ্চয়ের টাকা নমিনির পরিবর্তে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী পাবেন’ বলে রায় দেন। ২০১৬ সালের ৩রা এপ্রিল দেয়া রায়ে এ বিষয়ে হাইকোর্টের মতামত ছিল, নমিনি শুধুমাত্র একজন ট্রাস্টি। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নমিনি টাকাটা উত্তোলন করে উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করে দেবেন।
এই রায় প্রকাশের পরপরই দেশে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। কয়েক হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে রাখা হয়। মৃত ব্যক্তির আমানতের টাকা কাউকে দেয়া হচ্ছিল না। কারণ মৃত ব্যক্তির আমানতের টাকা উত্তরাধিকারীও দাবি করছিল, আবার নমিনিও দাবি করছিল। এই বিষয়ে সামসময়িক প্রধান প্রশ্নই হয়ে উঠে ‘টাকা তুমি কার? নমিনির নাকি উত্তরাধিকারীর?’
বিদ্যমান আইন এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কিছু রায়ের আলোকে আজকে এই বিষয়টার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। প্রথমেই বলে রাখি, মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের একচ্ছত্র অধিকার শুধুমাত্র নমিনির, তবে সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এই অধিকার উত্তরাধিকারীর মর্মে হাইকোর্ট বিভাগ একটা রায় দিয়েছিলেন ২০১৬ সালে যেটা আপিল বিভাগ স্থগিত করে দিয়েছেন এবং এখনো এই মামলা নিষ্পত্তি হয়নি।
বিদ্যমান আইন
সাধারণত, উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে তার ওয়ারিশগণ মালিকানা লাভ করেন। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন অর্থাৎ মৃতের ব্যাংকের সকল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার মনোনীত ব্যক্তির নিকট। দি ব্যাংকিং কোম্পানিজ অ্যাক্ট, ১৯৯১; দি ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট, ২০১০; দি কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট, ২০০১; দি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড রুলস, ১৯৯১ আইনগুলোতে নমিনি নির্বাচন এবং তার অধিকার লাভ সম্পর্কে বর্ণনা করা রয়েছে। আর সঞ্চয়পত্র বিধিমালা, ১৯৭৭ এ সঞ্চয়পত্রের বিষয়গুলো বলা হয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ধারা ১১৩ অনুযায়ী, আমানতকারী নমিনি মনোনীত (সিলেক্ট) করবেন এবং মনোনীত করা হলে, বলবত অন্য কোন আইনে বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, আমানতকারীর মৃত্যুর পর, সেই আমানতের ব্যাপারে যাবতীয় অধিকার লাভ করবেন একমাত্র নমিনি এবং অন্য যেকোন ব্যক্তি এই অধিকার হতে বঞ্চিত হবেন৷ এই ধারা অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যেখানে নমিনিকেই সকল কিছু পরিশোধের বিষয়ে বলা হয়। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো গ্রাহকের মুত্যু হলে তার নমিনি ছাড়া অন্য কারও কাছে টাকা দেয়া যাবে না।
১৮৭৩ সালের দি গভর্নমেন্ট সেভিংস ব্যাংকস অ্যাক্ট, এর ধারা ৪(২) অনুযায়ী, ‘The person or persons nominated shall be entitled, to the exclusion of all other persons, to receive the deposit or part which the nomination relates.’ অর্থাৎ ডিপোজিটর বা অ্যাকাউন্ট ধারীর মৃত্যুর পরে নমিনি আমানতের স্বত্ত্বাধীকারী হবেন। এই ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘notwithstanding anything contained in any other law for the time being in force or in any disposition.’ অর্থাৎ অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন এই ধারার বিষয় ই প্রাধান্য পাবে।
২০১৯ এর পেনশন সহজীকরণ নীতিমালা এর ৪র্থ স্মারক অনুযায়ী, পেনশনধারী কোন ব্যক্তি চাকুরীরত অবস্থায় তার পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকে তার মৃত্যুর পরে পেনশনের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ এর স্বত্ত্বাধিকারী মনোনীত করতে পারেন।
এছাড়াও দি ইন্সুরেন্স অ্যাক্ট ২০১০, দি কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট ২০০১, দি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড রুলস ১৯৯১ আইন গুলোতে নমিনি নির্বাচন এবং তার অধিকার লাভ সম্পর্কে বর্ণনা করা রয়েছে।
আদালতের রায়
এই বিষয়ে বিচার বিভাগীয় নজির পর্যালোচনা করে দেখা যায়, Ziauddin Ahmed & others Vs. Arab Bangladesh Bank & others মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের টাকা উত্তরাধিকারী নয় নমিনিই একচ্ছত্র অধিকারী মর্মে রায় দিয়ে বলেন, “The nominee shall be entitled to the payment to the exclusion of any other person. It therefore appears that the Bank shall be discharged of his obligation by making payment to such nominee.”{53 DLR (AD) 107}. অর্থাৎ অন্যান্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে নমিনিই আমানতের স্বত্ত্বাধিকারী হবেন।
এছাড়াও, Feroza Begum vs Bangladesh মামলায় দেখা যায় নমিনির বিরুদ্ধে উত্তরাধিকারীগণ মামলা দায়ের করেন মৃতের ব্যাংকে রাখা পেনশন এবং অন্যান্য টাকা পাওয়ার জন্য, এবং এই মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ নমিনিই এই টাকার অধিকারী মর্মে নমিনির কাছেই সকল টাকা পরিশোধ করার রায় দিয়ে মন্তব্য করেন যে, “The nominee shall be entitled to receive the money/benefits of the deceased. The nominee will have an exclusive right to receive the deposits/benefits on the death of the depositor and every other person shall be deprived of those rights.”(73 DLR 227).
এই মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ, পূর্বোক্ত মঞ্জুরুল হক চৌধুরী এবং অন্যান্য বনাম বিলকিস আরা বেগম এবং অন্যান্য মামলার বিষয় ভিন্ন মর্মে মন্তব্য করে বলেন যে, “In this case their lordships opined that Bank companies Act, 1991 is not at all applicable, as it does not deal with the Sanchaypatra (Saving Certificate). It deals with the deposit of the client of schedule bank.” অর্থাৎ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী বনাম বিলকিস আরা বেগম মামলার বিষয়বস্তু ভিন্ন যা সঞ্চয়পত্র কেন্দ্রীক। যেটা নিয়ন্ত্রিত হয় সঞ্চয়পত্র বিধিমালা ১৯৭৭ অনুযায়ী। মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ নমিনিকে ট্রাস্টি বলে অভিমত দিয়ে উত্তরাধিকারীই আমানতের অধিকারী মর্মে রায় দিলেও সেটা আপীল বিভাগ স্থগিত করে দেয়।
মন্তব্য
উপরের পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর মৃত্যুর পর নমিনি সকল অধিকার পাবেন এবং অন্য যে কোনো ব্যক্তি ওই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, তাতে বঞ্চিত ব্যক্তি উত্তরাধিকারীও হতে পারে কিন্তু নমিনিই প্রাধান্য পাবে। নমিনি মৃত ব্যক্তির আমানতের টাকা পাওয়ার এক মাত্র হকদার। যদিও সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মঞ্জুরুল হক চৌধুরী বনাম বিলকিস আরা বেগম মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ উত্তরাধিকারীকে আমানতের অধিকারী বলে অভিমত দিয়েছেন।
কিন্তু প্রথমত, সেটা শুধুমাত্র সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এবং দ্বিতীয়ত, সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ সেই রায় স্থগিত করে দিয়েছেন এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক আপীল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমানতকারীর মৃত্যুর পর তার নির্ধারিত নমিনিকেই আমানতের টাকা প্রদান করতে হবে। আইন অনুযায়ী এই টাকার সকল প্রকার স্বত্তাধিকারী একমাত্র নমিনি।
আমানতকারীর মৃত্যুর পরে তার আমানতের বন্টন বিবাদপূর্ণ না হয়ে সুষ্ঠুভাবে আইন অনুযায়ী বন্টন হোক, এই প্রত্যাশায়।
লেখক: আইন শিক্ষার্থী এবং সাধারণ সম্পাদক, জাস্টিস সার্ভড ফাউন্ডেশন।