দীপজয় বড়ুয়া: আপাত দৃষ্টিতে অনুসন্ধান ও তদন্ত শব্দ দুটির অর্থ প্রায় এক মনে হলেও আইনের ভাষায় দুটো শব্দই স্বতন্ত্র, রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞাও। ফৌজদারি কার্যবিধিতে অনুসন্ধান ও তদন্ত সম্পর্কে বলা হয়েছে। আজকের লেখায় অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে আইনগত সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
অনুসন্ধান (Inquiry)
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(ট) ধারায় “অনুসন্ধান” এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারা মতে “অনুসন্ধান” অর্থ এই আইন অনুযায়ী কোন ম্যাজিষ্ট্রেট অথবা আদালত দ্বারা পরিচালিত বিচার ছাড়া সকল কার্যক্রম” কে অনুসন্ধান (Inquiry) বলা হয়।
তদন্ত (Investigation)
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(১)(ঠ) ধারায় “তদন্ত” এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারা মতে “তদন্ত” অর্থ সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোন পুলিশ অফিসার কিংবা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অপর কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিচালিত সকল কার্যক্রম” কে তদন্ত (Investigation) বলা হয়।
অনুসন্ধান এবং তদন্তের মধ্যে পার্থক্য
অনুসন্ধান এবং তদন্ত একই বিষয় নয়। অনুসন্ধান আদালত বা ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু তদন্ত পুলিশ অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেট অনুমোদিত যিনি ম্যাজিস্ট্রট নয় তাকে দিয়ে করানো হয়। অনুসন্ধান জুডিসিয়াল বা নন জুডিসিয়াল হতে পারে। তবে তদন্ত কখনো জুডিসিয়াল হয় না, এটা একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া।
একই মামলায় একাধিক বিচারিক অনুসন্ধান হতে পারে কি না?
অভিযোগের সত্যতা নির্ধারণের জন্য আদালত একই মামলায় একাধিক বিচারিক অনুসন্ধান করার জন্য আদেশ প্রদান করতে পারেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন সত্যতা প্রথম অনুসন্ধানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাহলে পুনরায় বিচারিক অনুসন্ধানের আদেশ প্রদান করেবেন না।
বিচারিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মামলা আমলে নিলে পরীক্ষা করার দরকার নেই। [34 DLR 1982 Mofiz Uddin Ahamed & Others Vs. The State]
একই সাথে দুই সংস্থাকে তদন্তভার দেওয়া যায় কিনা?
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩ ধারাতে একই সাথে দুই সংস্থাকে তদন্তভার দেওয়ার বিধান রাখা হয়নি। এমনকি কার্যবিধির ১৫৬ এবং ১৫৭ ধারা আলোচনা করলেও এরূপ বিধান পরিলক্ষিত হয় নি।
[67 DLR(AD) (2015) 271 Secretary, Ministry of Public Administration Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, একই সাথে দুই সংস্থাকে তদন্তভার দেওয়া হলে একই বিষয়ে দুটি পৃথক প্রতিবেদন আসতে পারে, যা সাংঘর্ষিক হতে পারে এবং একই সাথে মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবানবন্দিও ভিন্ন হয়ে যেতে পারে যা মামলার জন্য মারাত্মক বাধার সৃষ্টি হতে পারে।
পুলিশ ইনভেস্টিগেশন( Police Investigation)
অপরাধ সংঘটনের সংবাদ প্রাপ্তির পর উর্ব্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে পুলিশ কর্মকর্তার কর্তৃক আইনানুযায়ী পরিচালিত উক্ত অপরাধের প্রাথমিক যাচাই বাছাই সংক্রান্ত কার্যক্রমকে “পুলিশ তদন্ত” বলে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(১)(ঠ) ধারায় “তদন্ত” এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারা মতে “তদন্ত” অর্থ সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোন পুলিশ অফিসার কিংবা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অপর কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিচালিত সকল কার্যক্রম।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ হতে ১৭৬ ধারায় “পুলিশের তদন্ত ক্ষমতা” সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। একটি আমলযোগ্য বা আমলযোগ্য নয়। মামলায় পুলিশের তদন্ত ক্ষমতা নিম্নরূপঃ
অ-আমলযোগ্য মামলার তদন্ত ক্ষমতা
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৫ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে যে, “প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি না নিয়ে পুলিশ অফিসার কোন অ-আমলযোগ্য অপরাধ সম্পর্কে তদন্ত করবেন না।”
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৫ ধারার (৩) উপধারায় বলা হয়েছে যে, “তদন্তের আদেশপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার তদন্তের বিষয়ে কোন আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তদন্তের ক্ষমতার অনুরূপ ক্ষমতা (বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা ব্যতীত) প্রয়োগ করবেন।”
[35 DLR 200 Abdul Gaffar Munshi and Others Vs. The State] মামলার রায়ে দেখা যায়, “প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট এর অনুমতি না নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা থানায় জি.ডি. এন্ট্রির মাধ্যমে দায়ের হওয়া ২৯৫-ক ধারার অ-আমলযোগ্য মামলার তদন্ত পরিচালনা করেন এবং তদন্ত শেষে মামলায় চার্জশীট প্রদান করেন। ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত তদন্ত আমলে নেয়া, সমন দেয়া এবং ইত্যাদি সকল বিচারিক কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন”।
আমলযোগ্য মামলার তদন্ত ক্ষমতা
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে যে, “কোন আমলযোগ্য অপরাধ ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ ছাড়াই পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করতে পারেন। গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশের এজাহারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। তদন্ত শেষে বা পরিদর্শন করে এসে এজাহার রুজু করা যায়।”
১৫৬ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে যে, “পুলিশ কর্মকর্তার এরূপ ক্ষমতার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।”
১৫৬ ধারার (৩) উপধারায় বলা হয়েছে যে, “যখন ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট কোন নালিশ দায়ের করা হয়, তখন তিনি এই ধারা অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দিবেন।”
[31 DLR (SC) 69 Bangladesh Vs. Tan Kheng kong] মামলার রায়ে দেখা যায় যে, “কোন আমলযোগ্য অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতা ব্যাপক। হাইকোর্ট বিভাগও এরূপ তদন্তের ক্ষেত্রে কোন হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।”
জুডিসিয়াল ইনকোয়ারি বা বিচার বিভাগীয় তদন্ত (Judicial Inquiry)
জুডিসিয়াল ইনকোয়ারি বা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলো, এমন এক ধরণের তদন্ত যেখানে একজন বিচারক তদন্ত করবেন; তিনি সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন ফরিয়াদি (অভিযোগ উত্থাপনকারী) ও তার দ্বারা হাজিরকৃত সাক্ষীদের; আসামীকে (যার বিরুদ্ধে অভিযোগ) তাকে হাজির করবেন না; আসামীকে ডিফেন্ড করবেন স্বয়ং তদন্তকারী।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২ ধারা মতে, (১) কোন ম্যাজিষ্ট্রেট যে অপরাধ আমলে নেয়ার জন্য ক্ষমতাবান সেই অপরাধের নালিশ পাওয়ার পর অথবা কার্যবিধির ১৯২ ধারা মতে উহা তার নিকট হস্তান্তরিত হওয়ার পর, তিনি যদি উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে কারণ লিপিবদ্ধ করে যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে নালিশ করা হিয়েছে তাকে হাজির হতে বাধ্য করার পরোয়ানা জারী স্থগিত রাখতে পারেন এবং নালিশের সত্যতা বা অসত্যতা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে নিজে ঘটনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পারেন অথবা তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট না হন্ তাহলে তার অধীনস্থ অন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ অফিসার তিনি যাকে উপযুক্ত মনে করবেন এরূপ অন্য কোন ব্যক্তিকে এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন, তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে আদালত নালিশ করেন সেক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে কার্যবিধির ২০০ ধারার বিধান পালন না করে এরূপ কো নির্দেশ দেওয়া যাবে না।;
তদন্তকারী ধরে নেবেন, অভিযুক্ত বা আসামীমর্মে উল্লেখিত/ কথিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নির্দোষ। এই পূর্ব অনুমান থেকে তার তদন্ত শুরু হবে। আসামী/ অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে ডিফেন্ড করার জন্য তিনি(তদন্তকারী) ফরিয়াদি ও তার উপস্থাপিত সাক্ষীদের উপযুক্ত জেরা করবেন; এই তদন্ত শেষে, যদি প্রতীয়মান হয়, অভিযুক্ত/ আসামী (ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ) নির্দোষ…. এমনটি প্রমাণিত হয়নি; কেবল তখনই তাকে বা তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করবেন। এ ধরণের তদন্তে, আসামী আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনও বক্তব্য বা সাক্ষ্য প্রদান করবে না।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।