মো. সাইফুল ইসলাম:
যুক্তিতর্ক শুনানীকালে হঠাৎ একটা বিষয় আমার নজরে আসল। এমন একটা বিষয় যার ফলে এজাহারকারীর ন্যায়বিচার পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। অথচ ঘটনা সত্য। সকল সাক্ষীরা ঘটনাকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছে।
ঘটনাটা সম্ভবত ২০১৬ সালের। আসামী শফিকের সাথে এজাহারকারী রেজিয়ার ঝগড়ার কারণটাও ছিল তুচ্ছ। সেদিন রেজিয়ার ছাগল আসামীর ক্ষেত খেয়ে নিচ্ছিল। এক কথা দুই কথায় ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা একটি বাঁশের খুটা দিয়ে শফিক রেজিয়ার পায়ে আঘাত করেন। রেজিয়া সেখানেই কাতরাতে থাকেন। তার চিৎকারে সাক্ষীরা তাকে ধরে সেদিনই তানোর হাসপাতালে ভর্তি করেন। এক্স-রে করে দেখা যায়, তার পায়ের দুটো হাড়ের মধ্যে মোটা হাড়টিই (Tibia) ভেঙ্গে ( Fracture) গেছে।
রেজিয়ার মামলা রেকর্ড হয় পেনাল কোডের ৩২৫ ও ৫০৬ ধারায়। ধারা জামিনযোগ্য হওয়ায় খুব সহজেই আমলী আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান শফিক। অথচ রেজিয়ার সুস্থ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ০৪ মাস। পায়ের উপর দাঁড়াতেই সময় লেগেছে দুই মাস। রেজিয়া হিসেব মেলাতে পারেন না। এত বড় আঘাত, তবু কেন একদিনের জন্য হাজতে গেল না আসামী!
ঘটনার প্রায় দু’বছর পর ২০১৮ সালের কোনো এক মাসে যুক্তিতর্ক শুনানী চলছে। এক পর্যায়ে দেখি, মামলার ঘটনার তারিখ ৩০/০৬/২০১৬ খ্রি. কিন্তু রেজিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ৩০/০৫/২০১৬ খ্রি. অর্থাৎ মামলার ঘটনার তারিখের এক মাস আগে রেজিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রথমে ভাবলাম চিকিৎসা সনদে নিশ্চয়ই করণিক ত্রুটি (Clerical mistake) হয়েছে। পরে দেখি, চিকিৎসার ছাড়পত্র একই কথা বলছে। সেই মর্মে চিকিৎসক সাক্ষী আদালতে এসে সাক্ষ্যও প্রদান করেছেন।
কোনো ফৌজদারি মামলায় যখন প্রসিকিউশন পক্ষ ঘটনার তারিখ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন ঘটনাটির স্থান ও ধরন প্রমাণের প্রশ্ন উঠতে পারে না। সময়, স্থান এবং ঘটনার ধরনের মধ্যে একটা শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। যেখানে অপরাধ সংঘটনের কোনো তারিখ নেই, সেখানে কোনো সময়, স্থান ও ঘটনার ধরণ থাকতে পারে না [Anwar Hossain Vs. The state (Criminal) 68 DLR page 76 ] । অনুরূপভাবে এই মামলাতেও ঘটনার তারিখ প্রমাণিত হয় নি।
এজাহারকারীর জেরায় দেখা গেল, এজাহার লিখেছেন থানার রাইটার। এজাহার লেখার পর তিনি তা পড়ে দেখেন নি। রেজিয়াকে তা পড়েও শোনানো হয় নি (মৌখিক এজাহার লিখিত হলে তা পড়ে শোনাতে হবে- সিআরপিসি’র ১৫৪ ধারা)। এতদিন সিনিয়র আইনজীবীদের এই জেরা মূল্যহীন মনে হতো। সেদিন প্রথম এর গুরুত্ব উপলব্ধি করলাম।
এ সম্পর্কে মাননীয় হাইকোর্টের একটা নজীরও পড়েছিলাম। Motaleb Vs. State; 9 BLC (2004) HCD 155 মামলায় হাইকোর্ট অভিমত দেন যে, “Ejhar written by an Advocate – Not read over to the informant- simply put his signature therein without going through the contents of it – creates doubt about the prosecution case. ” মাননীয় হাইকোর্টের এই নজীরটা যেন এই মামলার সাথে মিলে যায়। তবে কী মামলার ঘটনা মিথ্যা, সাজানো ও বানোয়াট!
আমার বারবার মনে হচ্ছিল কোথাও একটা ভুল হয়েছে। আবারও প্রত্যেক সাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করলাম। তাদের আবেগ, বলার ধরন, সাক্ষ্য গ্রহণকালে ভিকটিমের আচরন সম্পর্কিত নোট ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি দেখে মনে হল তারা সবাই সত্য বলছে।
আবার এটাও হতে পারে এজাহার যথাসময়ে দেওয়া হলেও তা বিলম্বে রেকর্ড হয়েছে। যেটাই ঘটুক না কেন এই মামলায় রাইটার রেজিয়ার ভালো করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন বিলম্বে মামলা দায়ের হলে মামলা সন্দেহজনক হয়। এজন্য তিনি মামলাটিকে শক্ত করার জন্য প্রকৃত ঘটনার তারিখের চেয়ে একমাস সময় কমিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এটা জানেন না সন্তোষজনক ব্যাখা থাকলে বিলম্বজনিত এজাহার প্রসিকিউশন মামলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। বরং এদেশে সন্তোষজনক ব্যাখ্যায় ঘটনার ২১ বছর পরেও মামলা দায়ের করে প্রমাণ হয়েছে। তাই মামলা দায়েরে বিলম্ব প্রসিকিউশন মামলা অবিশ্বাসের ভিত্তি নয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হতে পারে [Major Bazlul Huda vs. State; 62 DLR (AD) 2010 page 146, para 546 ]।
আমাদের সমাজে রাইটারদের মত এমন অনেক লোক আছে যারা কারো ভালো করতে গিয়ে খারাপ করে ফেলে। আমরাই প্রয়োজনের সময়ে ভুল ব্যক্তির কাছে গিয়ে হিতে বিপরীত করে ফেলি। শুধু থানার রাইটার নন, বাস্তবে দেখেছি কিছু কিছু আইনজীবীও মামলা নিজে লিখেন না। মোহরার ড্রাফট করেন। তারা টানা সই করে দেন। শুনানীকালে অনুপস্থিত বিজ্ঞ আইনজীবীকে ডেকে আনার জন্য বললে তারা বলেন, তারা তাদের আইনজীবীকে চেনেন না। তবে আইনজীবী সহকারীকে ঠিকই চেনেন। এভাবে মোহরার-রাইটারদের জ্ঞানের স্বল্পতা, বিচারপ্রার্থীদের সাথে সংযোগের অভাব এবং দায়িত্বশীলদের উদাসীনতার কারণে এমন ছোট ছোট ভুল বিচারের সময় বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তখন বিচার সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৫ দিন পর রায়ের দিন এলো। দুপক্ষই ডকে হাজির। আমি রায় ঘোষণার সময় আম্পায়ারের ভূমিকা থেকে সরে আসলাম। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। সম্পূর্ণ উল্টো বাঁক (U-turn) নিয়ে উভয় পক্ষকে আপস করার জন্য বললাম। এ বিষয়ে তাদের দীর্ঘ সময় বোঝালাম। আসামীপক্ষের আইনজীবীও সহযোগিতা করলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “তারা আপসে রাজী আছে কী না ?” এতদিন তারা আপসে রাজী না হলেও বিস্ময়করভাবে সেদিন রাজী হয়ে গেল। আমিও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রেজিয়াকে বললাম, “আপনার চিকিৎসা বাবদ কত খরচ হয়েছে?”
তিনি বললেন, “আমার স্বামীকে ছাড়া আপোষ কইরতে পাইরবো না।”রেজিয়া তার স্বামীকে ফোন করলেন। তার স্বামী শামছু নিজের ভ্যান নিয়ে দুই ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির।
শামছু জানালেন, “টাকা লিয়্যা আপোষ কইরবো না…টাকা লিয়্যা আপোষ কইরবো না। শফিক অর ভাবীর কাছে ক্ষমা চাহিলেই হবে”।
এজলাস ডায়াসের পাশে তিনজনকে মুখোমুখি করলাম। শফিক ক্ষমা চাইলো রেজিয়ার কাছে। রেজিয়া চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “তুই একবার যুদি আসতি, তাহিলে এই কোর্ট-কাচারি কইরতে যাতুক না।”
এজলাসে তিনজনেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। শেষ বিকেলে পিন পতন নীরবতায় তাদের কান্নার আওয়াজ ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। শান্ত বিকেলের ক্লান্ত ছায়ায় একটা ধূসর প্রলেপে আমারও মনটা ছেয়ে গেছে। তাদের কান্না ভাইরাসের সংক্রমণে নিজের অনিবার্য কান্নাকে সংবরণ করলাম। নিজেকে আড়াল করে দ্রুতই এজলাশ ত্যাগ করলাম।
প্রস্থানকালে শুধু বললাম, “আজ মামলায় দু’পক্ষই জিতেছেন। আজ থেকে আর আদালতে আসতে হবে না।”
খাস কামড়ায় ব্রিটিশ কবি George Herbert এর একটি উক্তি বারবার মনে হলো। উপলব্ধি করলাম ,
“A lean compromise is better than a fat lawsuit.”
(বি. দ্র. মামলার ঘটনা সত্য। ঘটনার তারিখ আনুমানিক। পক্ষগণের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।)
লেখক- মো. সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম।