মতিউর রহমান : সময় পেলেই কয়েদিদের সাথে কথা বলি আমি। এজলাসে এবং এজলাসের বাইরে আদালতের হাজত খানায় ১৪টি আদালতের সমস্ত আসামিকে জেলখানা থেকে সাতসকালে পুলিশের গাড়িতে করে আদালতের নীচ তলায় একটা রুমে এনে রাখা হয়। এই রুমটাকে আদালতের হাজতখানা বলে। তারপর এখান থেকে আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন আদালতের কাঠগড়ায়। শেষে আবার আদালতের হাজত খানায় এনে রাখা হয়। পড়ন্ত বিকালে বা ঘনায়মান সন্ধ্যায় পুলিশের লম্বা একটি গাড়িতে করে তাদের আবার নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে।
মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য দোতলা থেকে নিচে নামছি। আসামী ভর্তি পুলিশের লম্বা গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে আদালত ত্যাগ করে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে জেলখানার দিকে। গাড়িটার পিছনে দৌড়াচ্ছে ৮/৯ বছরের একটা শিশু, আর শিশুটার পিছনে তার মা। শিশুটা বাবা বাবা বলে ডাকতে ডাকতে হাত বাড়িয়ে দৌড়াচ্ছে গাড়ির পিছন পিছন। আচল মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে এক নারী।
আমি হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটার কাছে চলে আসি। কাঁধে হাত দেই।
~গাড়িতে কাকে নিয়ে গেল? তোমার বাবাকে?
ছোট্ট ছেলেটা আমার কথার কোন উত্তর দেয় না, কাঁদতে থাকে।
এবার নারীটাকে জিজ্ঞেস করি। সে জানায় আসামি তার স্বামী। মাদক মামলায় ধরা পড়েছে আজকে। আর কিছু বলতে চায় না সে। মাগরিবের নামাজ পড়তে চলে যাই মসজিদে।
প্রায় আসামিদের খবর নেই আমি। মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি আর মাস্ক পরিহিত আমাকে সহজে চিনতে পারেনা ওরা। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কয়েদিরা জেলখানা থেকে এসে আদালতের হাজতখানায় বসে থাকে। তাদের হাতে মোবাইল ফোন নেই, ইন্টারনেট নেই, সাথে বউ-বাচ্চা কেউ নেই। খুব বিরক্তিকর আর মন খারাপ করে সময় কাটায় তারা। এগুলো দেখে দেখে আমার খুব খারাপ লাগে।
আদালতের হাজতখানার ফ্যান দুটোর ক্যাপাসিটর দুর্বল হওয়ায় ঘুরে না আর। ভেন্টিলেশন নেই। বাথরুমটা অনেকদিন থেকে নষ্ট হয়ে গ্যাস তৈরি হয়েছে। পাঁচটা মিনিট ভেতরে থাকতে পারিনা আমি। হাজত খানা থেকে বের হয়েই ফোন দেই গণপূর্ত বিভাগে। চিঠি দেই। পরিষ্কার করা হয় হাজতখানা।
সকাল ৯ টা থেকে বিকেল পাঁচটা এই দীর্ঘ সময় কিছুতেই কাটতে চায় না তাদের। কী করলে ওদের ভালো লাগবে জানতে চাই। কয়েদিরা বই পড়তে চায়। তারা বই পড়ে সময় কাটাতে চায়। ঠিক তো! বই একমাত্র পারে অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোয় ফেরাতে। অপরাধ দূর করতে। আমার আর তর সয়না, ধৈর্য কুলায় না। যেভাবেই হোক ওদের জন্য বই পড়ার ব্যবস্থা করবো আমি। নাম দেবো আদালত পাঠাগার।
এবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পালা। ফার্নিচারের দোকানে বানাতে দেয়া হয় ওদের জন্য দুটি বুকসেলফ। বুক সেলফ বানাতে বানাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এরপর নিজে বাজারে গিয়ে বই কিনি। বিভিন্ন রকমের বই। ইতিহাস ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, ডেল কার্নেগি, ডা: লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন, মহৎ জীবন, মানব জীবন, ধর্ম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী সহ বেশ কিছু বই। বই কিনতে কিনতে টাকা ফুরিয়ে যায় এক সময়।
বাজার থেকে বুকসেলফ আর বই হাতে করে ফেরার সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। বিদ্যুৎ চমকায়। চমকানো আলোতে দুই কিলোমিটার পথ হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি আদালতে। বৃষ্টিতে যাতে না ভিজে এজন্য ছোটবেলায় বৃষ্টির দিনে স্কুল থেকে বই নিয়ে ফেরার মত করে গায়ের জামা দিয়ে ঢেকে রাখি বইগুলো।
ড্রিল মেশিনওয়ালাকে খবর দেওয়া হয়। রাতেই লাগানো হয় দুটি বুক সেলফ। নাম দেওয়া হয় আদালত পাঠাগার। পরের দিন আলোময় এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে আদালতে গিয়ে দেখি হাজতখানায় কয়েদিরা মনের সুখে বই পড়ছে।
আমার চোখ আর বাধা মানে না।
বাংলাদেশের আদালতের হাজত খানায় কয়েদিদের জন্য বই পড়ার সুযোগ এটাই প্রথম। বিকালে আরো কয়েদি আসে। আমি নিজ হাতে ওদের হাতে বই তুলে দেই। ছোট বাচ্চার মত মাথা ঝুঁকেঝুঁকে কয়েদিরা বই পড়ে। এখন ওরা সকালে এসেই বই পড়া শুরু করে। বই পড়ে বিকাল পর্যন্ত, সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিরক্তিকর ক্লান্ত সময় গুলো এখন নিমিষেই পার হয়ে যায় ওদের।
গতকাল (রোববার, ৩০ অক্টোবর) আবার হাজত খানায় গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখি একজন কয়েদি বই পড়ে হাসছে। আমি আড়াল থেকে দেখি সে হাসি। ওই হাসি এখনো ছড়িয়ে আছে আমার দেহ মনে।
এদিন সকাল সাড়ে আটটায় একটা পার্সেল আসে। প্যাকেট করা একটা বড় কার্টুন। প্রাপকের ঠিকানায় আমি আর প্রেরক বেগম শাম্মী হাসিনা পারভীন, মাননীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, কিশোরগঞ্জ। ভয়ে ভয়ে খুলে দেখি ভেতরে বই আর বই। প্রতিটি বইয়ের ফ্লাই লিফে লেখা আদালত পাঠাগারের জন্য শুভেচ্ছা।
আমার আদালত পাঠাগারের জন্য বই পাঠিয়েছে কিশোরগঞ্জের মাননীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শাম্মী হাসিনা পারভীন স্যার। আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর ছোটবেলায় পড়া এবং ছাত্র জীবনের পড়া বেশ কিছু বই তিনি দিয়েছেন পাঠাগারে কয়েদিদের পড়ার জন্য। কয়েকদিন আগে রংপুর থেকে কিছু ধর্মীয় বই পাঠিয়েছেন একজন অনুরাগী পাঠক। বই দিতে চেয়েছেন পঞ্চগড় আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ আইনজীবীরাও। বাড়িতে থাকা পুরাতন বইগুলো একটা দুইটা করে নিয়ে আসে আদালতের কর্মচারীরাও।
আমার পাঠাগারটা এখন বড় হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বড় হবে, ছড়িয়ে যাবে দেশের সব জেলার আদালতে। একদিন ছড়িয়ে যাবে বিদেশেও।
লেখক : অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পঞ্চগড়।