সড়কের পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা থেকে অননুমোদিত স্থাপনা অপসারণের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও রাজউক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত এক আবেদনের শুনানি নিয়ে আজ মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবির লিটনের বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্ট রাজউক চেয়ারম্যান এবং দুই মেয়রকে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা থেকে দোকানসহ সব অননুমোদিত কাঠামো অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
কিন্তু এ আদেশ অমান্য করায় কেন তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে রুলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে দুই সিটি মেয়র ও রাজউক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করার অভিযোগে এইচআরপিবি একটি আদালত অবমাননার আবেদন করে আদালতে।
আবেদনের শুনানির সময় এইচআরপিবির আইনজীবী মনজিল মোরসেদ হাইকোর্টকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কয়েক সপ্তাহ আগে রাজউক চেয়ারম্যান ও ঢাকার সিটি মেয়রদের আইনি নোটিশ দেওয়া হয়।
কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি যা আদালত অবমাননার শামিল।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিকে এই নির্দেশনা মানার বিষয়ে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদনও জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
আদেশের পর অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জানান, ঢাকার রাস্তার পাশে ভবন তৈরিতে রাজউক কর্তৃক অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। অথচ অনেক ভবন মালিক গাড়ি পার্কিংয়ের নির্ধারিত জায়গায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান/দোকান করেন বা বসবাস করেন। তাদের গাড়িগুলো ভবনের সামনের রাস্তায় পার্কিং করায় ঢাকা শহরে মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়।
তাই, ঢাকার রাস্তা থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও গাড়ি পার্কিং বন্ধে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)-এর পক্ষে ২০১৫ সালে একটি রিট করা হয়। সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পর আদালত রুল জারি করে আদেশ দেন। রুলে অনুমোদনহীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অবৈধ স্থাপনা অপসারণের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
একই সঙ্গে কোন কোন ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় নকশাবহির্ভূত স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, রাজউক চেয়ারম্যানকে ৬০ দিনের মধ্যে সে তালিকা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে রাজউক গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকার কয়েকশ ভবনের তালিকা আদালতে দাখিল করে। এরপর বিভিন্ন সময় রাজউক প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে জানায়, ২০১৬ সাল থেকে তারা এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। একপর্যায়ে রুলের চূড়ান্ত শুনানি করে ২০১৯ সালের ৩ জুলাই রায় দেন হাইকোর্ট।
সে রায়ে রাজধানীতে সড়কের পাশে যেসব ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় নকশাবহির্ভূতভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান তৈরি করা হয়েছে- সেগুলো এক মাসের মধ্যে ভেঙে ফেলতে ভবন মালিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর ভবন মালিকরা তা না করলে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে তা করতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ভাঙার খরচ ভবন মালিকের কাছ থেকে আদায় করতে বলেন আদালত।
এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা থেকে অননুমোদিত পার্কিং সরাতে আইনগত পদক্ষেপ নিতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু এই রায় বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এবং রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আদালতে প্রতিবেদন না দেওয়ায় গত বছর দুই মেয়র ও রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে আদেশ বাস্তবায়নের জন্যে বলা হয়। সে নোটিশের পরও পদক্ষেপ না নেওয়ায় আদালত অবমাননার অভিযোগ আনতে আবেদন করা হলে সেই আবেদনের শুনানির নিয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আগের দায়ের করা রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্ট ৩০ দিন সময় দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে বলেন। ওই বিজ্ঞপ্তিতে কার পার্কিংয়ের জায়গা থেকে অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়।
বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর এবং বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
রায়ে আদালত বিবাদীদের (ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরশনের মেয়র, রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা) ছয় মাসের মধ্যে ভবনের কার পার্কিং এলাকা থেকে দোকান/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান/স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এর খরচ ভবন মালিকের কাছ থেকে আদায়ের নির্দেশ দেন। রায়ে রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতেও বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ওই বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
আদালতের এসব নির্দেশনা প্রতিপালন না হওয়ায় এইচআরপিবির পক্ষে নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে সাত দিনের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জানানো হয়। কিন্তু যানজট নিরসনে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় হাইকোর্টে আদালত অবমাননার অভিযোগে আবেদন করা হয়।
ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আজ আদালত ঢাকার দুই সিটির মেয়র ও রাজউকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে রুল জারি করেন। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করায় তাদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।