ফিরোজ উদ্দিন : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪(১) এর অভিপ্রায় অনুসারে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অন্যসব নির্বাচন প্রক্রিয়া হতে ভিন্ন এবং দেশের রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দলের প্রধান নেতার পছন্দের উপর বর্তায় বিধায় তিনি যাকে মনোনয়ন দিবেন তাকে দলগতভাবে রাষ্ট্রপতির পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়ে থাকে।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অতীতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যাকে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এবং সকল রাজনৈতিক দলের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে প্রতিয়মান হয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত স্বচ্ছ ইমেজধারী, বিতর্কহীন এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান করে থাকে।
বিরোধীদল হতে রাষ্ট্রপতির মনোনয়নে কোন আইনগত বাধা নেই এমনকি যেকোন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারেন তবে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যগণ তাদের দলের প্রধান কর্তৃক রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত ব্যক্তি ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ নেই। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভাবে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫০(১) অনুসারে রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে ৫(পাঁচ) বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে উত্তরাধিকারী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত উক্ত দায়িত্ব পালনে কোন বাধা নেই। মেয়াদপূর্তীতে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অনুষ্ঠান সংবিধানের ১২৩(১) অনুসারে মেয়াদপূর্তীর পূর্ববর্তী ৯০ (নব্বই) হতে ৬০(ষাট) দিনের মধ্যে শূন্যপদে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তবে রাষ্ট্রপতি যে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন সেই সংসদের মেয়াদ কালে রাষ্ট্রপতির মেয়াদপূর্তী হলে নির্বাচনের প্রয়োজন নেই এবং উক্ত সংসদের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হয়।
রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, পদত্যাগ বা অপসারণের ফলে রাষ্ট্রপতির পদশূন্য হলে পরবর্তী ৯০(নব্বই) দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন করতে হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯(ক) অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব মূলত এককভাবে নির্বাচন কমিশনের। কমিশন সংবিধান এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১ অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব পালন করে থাকে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১ এর ধারা (৩) অনুসারে কমিশন নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনায় নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসাবে গণ্য। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কমিশন সংসদ-সদস্যদের বৈঠকে সভাপতিত্ব এবং কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীদের সহায়তায় নির্বাচন পরিচালনা করবেন।
এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা করে থাকে কারন এই আইনের ধারা (৪) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সংসদ-সদস্যদের বৈঠক সংসদ কক্ষে অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। তবে বিশেষ কোন পস্থিতিতে অন্য কোন জায়গায় রাষ্ট্রপতির নির্বাচন করা যাবে কিনা সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
কমিশন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের পূর্বে ধারা ৩(২) অনুসারে সংসদ নির্বাচন, উপ-নির্বাচন এবং নির্বাচিতদের শপথ সাপেক্ষে হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রস্তুত করবেন এবং প্রস্তুতের পর কমিশন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে কমিশন ধারা ৫ অনুসারে সংসদ-সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে সরকারি গেজেটে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে মনোনয়পত্র দাখিলের দিন, সময়, স্থান, মনোনয়নপত্র পরীক্ষা দিন, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষদিন এবং ভোটগ্রহণের দিন ও সময় নির্ধারণ করেন।
নির্বাচন যদি সংসদের অধিবেশন চলাকলীন সময়ে করতে হয় তাহলে কমিশন ধারা ৫(২) অনুসারে নির্বাচনের অনূন্য (সাত) দিন পূর্বে কমিশন স্পীকারের সঙ্গে আলোচনা করে উক্ত প্রজ্ঞাপন জারীর ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু যদি সংসদের অধিবেশন না থাকে তাহলে স্পীকারের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন ধারা ৫(৩) অনুসারে প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত দিনের অনূন্য ৭ (সাত) দিন পূর্বে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংসদ-সদস্যদের বৈঠক আহ্বান করবেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৪) এ উল্লেখিত যোগ্যতা অর্জন করতে হয় অন্যথায় কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন না। বৈঠক আহ্বানের পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে আগ্রহী যেকোন ব্যক্তি মনোনয়নের জন্য ধারা ৬ অনুসারে প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত দিনে মনোনয়ন দাখিল করতে পারবেন।
মনোনয়ন দাখিলের সময় মনোনয়নপত্রে আগ্রহী ব্যক্তির সম্মতি স্বাক্ষরসহ প্রস্তাবক হিসাবে একজন সংসদ-সদস্যের স্বাক্ষর এবং অপর একজন সংসদ-সদস্যের স্বাক্ষর দ্বারা সমর্থিত হতে হবে অন্যথায় মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে না।
কমিশন ধারা ৭ অনুসারে দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র পরীক্ষা করে বৈধ মনোনয়নপত্রের তালিকা প্রস্তুতপূর্বক বৈধ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করবেন। কমিশনের নিকট একজন ব্যক্তিকে বৈধ প্রার্থী হিসাবে বিবেচিত হলে উক্ত বৈধ প্রার্থীকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করবেন এবং একাধিক মনোনয়ন বৈধ হলে তাদের সবাইকে বৈধ প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করবেন।
যদি কোন প্রার্থী তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করতে চান তাহলে ধারা ৮ অনুসারে স্বাক্ষরযুক্ত নোটিশে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করতে পারবেন। তবে কোন প্রার্থী নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহারের পর পরবর্তীতে উক্ত প্রত্যাহারের নোটিশ খারিজ করতে পারবেন না। যদি একজন প্রার্থী ব্যতীত অন্যসব প্রার্থী তাদের নিজ নিজ প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন তাহলে একক প্রার্থী হিসাবে যিনি অবশিষ্ট থাকবেন তাকে কমিশন নির্বাচিত বলে ঘোষণা করবেন।
কোন প্রার্থী যদি তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করেন এবং নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর সংখ্যা একাধিক হয় তবে সেক্ষেত্রে কমিশন ধারা ৯ অনুসারে অনুরূপ প্রার্থী, তাদের প্রস্তাবক ও সমর্থকদের নাম ভোটগ্রহণের দিন বেলা ১২ (বার) টার পর সংসদ-সদস্যদের বৈঠকের শুরুতে ঘোষণা করবেন।
অতপর ধারা ১০ অনুযায়ী কমিশন ভোটগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্যালট পেপার প্রস্তুত করবেন। প্রত্যক সংসদ-সংসদের একক ও প্রকাশ্য ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের জন্য ব্যবহৃত প্রত্যক ব্যালটে ২ (দুই) টি অংশ থাকে যথা:- (১) কাউন্টার ফয়েল- যেখানে প্রত্যক ভোটারের নাম ও বিভক্তি সংখ্যা থাকবে এবং প্রত্যেক ভোটারের স্বাক্ষরের জন্য স্থান নির্ধারিত থাকবে এবং (২) আউটার ফয়েল- যেখানে প্রত্যেক ভোটারের বিভক্তি সংখ্যা এবং রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের নাম আদ্যাক্ষর অনুযায়ী ক্রমানুসারে সরলরেখার মধ্যে পৃথকভাবে লেখা থাকবে এবং প্রত্যেক নামের বিপরীতে ভোটার কর্তৃক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভোট প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান।
প্রত্যেক ভোটার তার জন্য ব্যালটের কাউন্টার ফয়লে নিজের নাম স্বাক্ষর করে ব্যালট সংগ্রহ করবেন এবং ব্যালটের আউটার ফয়েলে যাকে ভোট দিবেন তার নামের বিপরীতে নির্দিষ্ট স্থানে নিজের পূর্ণ নামে স্বাক্ষর করে ভোট প্রদান করে ব্যালট বাক্সের অভ্যন্তরে রাখবেন।
ভোটগ্রহণ শেষে কমিশন ধারা ১১ অনুসারে গৃহীত ভোট গণনা করবেন এবং যিনি সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত হবেন তাকে কমিশন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করবেন। যদি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণ সমান সংখ্যক ভোট পান সেক্ষেত্রে কমিশন লটারির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করবেন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে কমিশনের ঘোষণাই চূড়ান্ত।
লেখক : লেজিসলেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট, আইন শাখা-১, জাতীয় সংসদ সচিবালয়। firojlawru@gmail.com