ইংরেজি ভাষায় দেওয়া আদালতের রায় সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় না। ভুক্তভোগীরা রায়ের ভাষা বুঝতে পারেন না। তাই আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে ১৯৮৭ সালের ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’কে চ্যালেঞ্জ করে হওয়া রিটের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে। এর জন্য জনগণকে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে আদালতের রায় বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন’ শিরোনামে মুক্ত আলোচনা সভায় শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষকেরা এ কথা বলেন। সভার আয়োজন করে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন।
সভাটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রচলিত কিছু শব্দের অনুবাদ না করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা সম্ভব। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্মরণ করা হয় প্রথম আলোর প্রয়াত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানকে। বিচার বিভাগ নিয়ে মিজানুর রহমান খানের বিস্তর লেখালেখির প্রশংসা করে বলা হয়, তিনি বাংলাকে জীবিকার ভাষা (বিচার বিভাগের) হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক নাহিদ ফেরদৌসী। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ করা হলেও দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে অধস্তন আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। উচ্চ আদালতে ২০১২ সালে হাইকোর্ট বিধিমালা ১৯৭৩ সংশোধনের মাধ্যমে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষা ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়। এখন ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় রায় লেখা শুরু হলেও সংখ্যায় অনেক কম। ১৯৯০ সালে উচ্চ আদালতে প্রথমবার তৎকালীন বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী আদালত কার্যক্রম বাংলায় লিখেছিলেন।
আলোচকদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ হওয়ার পর আদালত প্রাঙ্গণে হইচই পড়ে গিয়েছিল। আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে রিট হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রায়ে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে কোনো বাধা থাকেনি। আশ্চর্যজনকভাবে সরকার ওই রিটের বিরুদ্ধে কখনো আপিল করেনি। যে বাংলা ভাষার জন্য মানুষ রক্ত দিয়েছে, সেই ভাষাকে সম্মান দেওয়ার জন্য আইনটিকে ধরে ওই রিটের বিরুদ্ধে এখন আপিল হওয়া উচিত। ওই রিট থেকে অব্যাহতি পেতে জনগণকে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বরিশালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ভাষাকে একই সঙ্গে সহজবোধ্য এবং মানসম্মত হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, ইংরেজি ভাষায় লেখা হয় বলে আদালতের রায় সাধারণ লোকজন বোঝে না। রায় বোঝার জন্য আইনজীবীকে অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। বাংলা ভাষায় রায় লেখার জন্য আদালত ও সংসদকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা জজ মো.শাহজাহান বলেন, সমাজের মনোভাব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে ইংরেজিতে কথা বলা লোকদের ‘কুলীন’ মনে হয়। ভাষা বিশেষ প্রাধান্য পাওয়ার সুবিধা দিচ্ছে কি না, সেটাও দেখা দরকার। রায় ইংরেজিতে হওয়াতে কার কেন ‘ফাঁসি হলো’, কার কেন ‘জমি হাতছাড়া হলো’ তা বিচারপ্রার্থীরা রায় শুনে বুঝতে পারেন না। তাঁর মতে, দুর্নীতি ও আর্থিক দৈন্য দূর করা গেলে ইংরেজির ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে।
মানবাধিকারকর্মী শীপা হাফিজা বলেন, ১৯৫২ থেকে এ পর্যন্ত ৭০ বছর, মাতৃভাষা বাংলাকে বিচারিক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট সময় গেছে। এখনো এ নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে, কিছু অর্জন হচ্ছে না।
বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন আলোচকেরা। দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক আসজাদুল কিবরিয়া বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থায় পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে নিজের ভাষা থেকে পেছালাম আমরা।’
লেখক ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ভাষা একটি মানুষের জীবন, পরিচয়। পাঠ্যপুস্তকের ভাষা যখন সহজ করা হচ্ছে না, তখন আদালতে সর্বস্তরে বাংলা চালু করা কঠিন।
লেখক ফিরোজ আহমেদ বলেন, বাংলা ভাষার প্রচলন করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দায়িত্ব ছিল আইনের বিষয়গুলো বাংলায় অনুবাদ করা। এই বিভাগ সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর মতে, আইনের ভাষা দুর্বোধ্য করে রাখার বিষয়টি ইচ্ছাকৃত।
লেখক, গবেষক রাখাল রাহা জানান, তিনি অর্থনীতির ছাত্র থাকা অবস্থায় অর্থনীতির বিষয় বাংলায় অনুবাদ করে পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজি ভাষায় পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীদের চেয়ে কম নম্বর পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, সর্বত্র ইংরেজি অনুকূল পরিবেশ রেখে বাংলায় মাতম করা ভণ্ডামি।
২০২১ সালে রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত সারিয়া সুলতানা সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।
সভার সভাপতিত্ব করেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।