বিভিন্ন আইন সত্ত্বেও দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনও কাঙ্ক্ষিত অর্জন লাভ করা সম্ভব হয়নি। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এমনিতে করা সম্ভব নয়। এজন্য সংগ্রাম প্রয়োজন। এছাড়া বিচারে বিলম্বের কারণে নারীরা বেশি ভুক্তভোগী হন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ফ্ল্যাড ও বাংলা ট্রিবিউনের যৌথ উদ্যোগে শনিবার (৪ মার্চ) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। নারীদের অধিকার ও প্রাসঙ্গিক আইন (স্বাধীনতাউত্তর ৫১ বছরের মূল্যায়ন) শিরোনামে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন আইন সত্ত্বেও দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনও আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্জন লাভ করা সম্ভব হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্ল্যাড) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা অনেক আইন পেয়েছি। মানবপাচার, পারিবারিক সহিংসতা নিরোধসহ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক আইন এসেছে। আইনের আওতায় এসেও আমাদের নারী অধিকারের বিষয়ে যতটুকু অর্জন হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু আমরা পাইনি।
আক্ষেপ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, আইন হয়েছে ঠিকই কিন্তু অনেকাংশে আমাদের নারীদের অর্জনের জায়গাটিও দিন দিন কর্তন করা হচ্ছে। যৌন হয়রানি রোধে একটি গাইডলাইন ছিল যা আইনে রূপান্তর করা হয়নি। এভাবে অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে আমাদের কাজ করার রয়েছে। তাহলেই হয়তো আমরা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব করতে পারবো।
বিচারে বিলম্বের কারণে নারীরা বেশি ভুক্তভোগী হন বলে গোলটেবিল বৈঠকে মন্তব্য করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. মো. শাহজাহান। তিনি বলেছেন, আইন-আদালতের বাইরে যারা আছেন তারা ভাবেন, জজেরা মামলা শোনেন না। তাহলে কি বিচার বছরের পর বছর চলতে থাকবে? তাই এর সহজ উপায় হলো বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি করা। দেশের এ মুহূর্তে অন্তত পাঁচ হাজার জজ থাকা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, দেশের সচিব-ডেপুটি-সহকারীসহ বিভিন্ন সচিবদের পদসংখ্যার তুলনায় তাদের নিয়োগ হার বেশি রয়েছে। অথচ বিচারক নিয়োগ করার কথা বলা হলে উত্তর দেওয়া হয় বাজেট স্বল্পতার। এর ফলে বিচার পেতেও দেরি হয়। আর এর কারণে বেশি ভুক্তভোগী হতে হয় নারীদের।
তিনি আরও বলেন, সরকার যে বসে আছে তা কিন্তু বলা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টসহ সারাদেশে লিগ্যাল এইড অফিস রয়েছে। সেখানে ভুক্তভোগীরা আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও বিচার চেয়ে যেতে পারছেন। লিগ্যাল এইড অফিস থেকে মামলা চালাতে পরামর্শ এমনকি বিনামূল্যে আইনজীবীও নিয়োগ করে দেওয়া হচ্ছে।
অসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. মো. শাহজাহান বলেন, নারীর অধিকারের সচেতন হতে হলে শিক্ষার বিষয়ে জোর দিতে হবে। তবে সেটি যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হতে হবে তা কিন্তু না। এছাড়াও এক্সেস টু জাস্টিস নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আর্থিক সক্ষমতা থাকলে বিচারিক সিস্টেমে আমরা প্রবেশ করতে পারবো। তবে সবকিছুর মূলে আমাদের সচেতন হতে হবে। পত্র-পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করতে হবে।
পারিবারিক আদালতের মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পারিবারিক আদালতের মামলা হলে অনেকেই বছরের পর বছর ঘুরতে থাকেন। অনেকেই মনে করেন বিচারকরা কাজ করেন না। অথচ অনেকের জানা নেই এসব আদালতে কতটা মামলার চাপ রয়েছে। তাই কোনও মামলা হলে তা শেষ হতে তো সময় লাগবেই।
বর্তমানে আমাদের আদালতগুলোতে এক তৃতীয়াংশ নারী জজ রয়েছেন। এছাড়াও সারাদেশে বিচারক রয়েছেন প্রায় ১৭শ’ জন। কিন্তু মামলা চলমান রয়েছে ৩৫ লাখের বেশি। তাই একটি মামলাতে তিনমাস পরে তারিখ পড়া অস্বাভাবিক কিছু না। যদি পর্যাপ্ত জজ নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে বিচারও দ্রুত হবে। তাহলে কি আর জজদের দোষ দেওয়া চলে? বলেন তিনি।
মো. শাহজাহান মনে করেন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এমনিতে করা সম্ভব নয়। এজন্য সংগ্রাম প্রয়োজন। পারিবারিক আদালতের আইনে অনেক নারী অধিকারের কথা বলা হলেও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একসঙ্গে সচেতন হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
পারিবারিক আদালতের বিচারকদের কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে বৈঠকে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাইমা হক। কোনও দম্পতি যখন তালাকের আবেদন করেন, তখন তাদের সন্তান থাকলে তাকে কার জিম্মায় দেওয়া উচিত, সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতি কী এগুলো বোঝার জন্য বিচারকদের এ ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ড. নাইমা হক বলেন, মুসলিম আইনটিকে একচেটিয়া বৈষম্যমূলক বলা যাবে না। তা বলতে গেলে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার হবে। তালাকের ক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কেউ ডিভোর্স দিতে চাইলে চেয়ারম্যান বা মেয়রকে নোটিশ দিয়ে জানাতে হয়। এরপর তা তিন মাস পর কার্যকর হয়। তালাকের সঙ্গে দেনমোহরের বিষয়টিও চলে আসে। তালাকে তাওফিস হলেও মেয়েরা দেনমোহর পাবেন। মুসলিম আইনে তালাকটি কোরানিক প্রভিশন হিসেবে এসেছে। কিন্তু আমরা স্ট্যাটিউটরি প্রভিশনে যেতে পারি কিনা তা ভাবা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের দেখা উচিত, আমরা আমাদের মুসলিম আইন, পারিবারিক আদালত আইনের কীভাবে প্রয়োগ করছি। পারিবারিক কোর্টে আমরা বাচ্চার কাস্টডির মামলা বেশি দেখি। ইদ্দতকালীন সময়ের ভরণপোষণের বিষয়টি আসে। এ নিয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা গিয়েছে। কিন্তু আইনের বিধানটি হাইকোর্টে বহাল রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের পারিবারিক আদালত আদৌ পারিবারিকভাবে গঠিত হয়েছে কিনা? এখানে সহকারী জজকে দিয়ে বিচার করানো হয়। কিন্তু পারিবারিক কাউন্সেলিং নিয়ে কি তাদের কোনও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়? তাহলে কীভাবে পরিবারের মতো বিষয়টি কাউন্সেলিং ছাড়া বিচার করা সম্ভব? এসব বিষয়গুলো আমাদের গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, খোলা তালাকের (নারীর স্বেচ্ছায় তালাক) সঙ্গে দেনমোহরের বিতর্ক আসে। কিন্তু সেটি কেন আসবে? এটাতো নারীদের সম্মান হিসেবে দেওয়া হয়। এমন যদি করা যেত নারীর ভরণপোষণ তার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত পুরুষকেই বহন করতে হবে তাহলে কিন্তু সেই পুরুষ ভয়ে থাকবে।