৯৯৯। জাতীয় জরুরি সেবার হটলাইন নম্বর। যেকোনো বিপদে পড়লে, সাইবার অপরাধের শিকার হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া যায়। মানুষের বিপদে সহায় হিসেবে যুক্ত হওয়া এই সেবা পরিচালিত হয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এবার আরও সহজ হচ্ছে জাতীয় জরুরি সেবাগ্রহণ পদ্ধতি। এই সেবায় যুক্ত হচ্ছে ‘কলার লোকেশন ট্র্যাকার’। ফলে নাম-ঠিকানা-অবস্থান না বলতে পারলেও জাতীয় সেবা দেওয়া এ কর্তৃপক্ষ সহজে পৌঁছে যাবে সেবাপ্রত্যাশীর কাছে।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলার লোকেশন ট্র্যাকার না থাকায় ৯৯৯-এ ফোন করলে গ্রাহককে তার নাম-ঠিকানা বলতে হতো। গভীর রাতে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় পড়লে, গভীর সমুদ্রে, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অথবা ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে গহীন অরণ্যে হারিয়ে গেলে নিজেদের সঠিক অবস্থান বলতে পারতেন না সেবাপ্রার্থীরা। কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচয় জানাতেও চলে যেত অনেকটা সময়। এতে ৯৯৯ কর্তৃপক্ষকে সেবা দিতে বেগ পেতে হতো।
এছাড়া অকারণেও বহু মানুষ ফোন করেন ৯৯৯-এ। ভূতুড়ে ফোনও (কল করে কথা বলে না) করেন অনেকে। কেউ কেউ ফোন করে বলেন, তার বাচ্চা খেতে চাইছে না, এটার সমাধান কী? এছাড়া ফোন করে সেবা না চেয়ে নারী কণ্ঠ পেলে উদ্ভট কথাবার্তা বলেন কেউ কেউ। মিসড কল দেওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। একই নম্বর থেকে একাধিকবার ব্লাঙ্ক কলও দেওয়া হয়। এসব ফোন নম্বরে ৯৯৯ থেকে সতর্ক করে পাঠানো হয় মেসেজ। এরপরও বারবার ফোন করে বিরক্ত করলে সেই নম্বর ব্লক লিস্ট করে রাখা হয়।
এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ৯৯৯-এ যুক্ত হচ্ছে কলার লোকেশন ট্র্যাকার। গ্রাহকের লোকেশন ও পরিচিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে ৯৯৯ সংশ্লিষ্টদের কাছে। সময় নিয়ে গ্রাহকের নাম-ঠিকানা বলা লাগবে না। এতে যেমন গ্রাহকের সময় বাঁচবে, অন্যদিকে আরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেবা দিতে পারবে ৯৯৯। এছাড়া বিরক্তিকর কল এড়াতেও কলার লোকেশন ট্র্যাকার কাজে আসবে।
৯৯৯ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর সেবাটি চালুর পর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৬১টি কল এসেছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮২টি কল সরাসরি সমাধানযোগ্য ছিল। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, মোট কলের ১ কোটি ৮০ লাখ ৬৬ হাজার ৬২২টির বিপরীতে কোনো না কোনোভাবে সার্ভিস দেওয়া হয়েছে, যা মোট কলের ৪১ দশমিক ২০ শতাংশ।
পাশাপাশি ৯৯৯ এ অপ্রয়োজনে অনেকে ফোন করছেন। দিচ্ছেন মিথ্যা তথ্যও। গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে ট্রিপল নাইনে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৯টি অপ্রয়োজনীয় কল এসেছে, যা মোট কলের ৫৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে বিরক্তিকর কলই ছিল ২৩ লাখ ১১ হাজার ৯৬৫টি।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই বিরক্ত করা কলের জন্য দণ্ডের বিধান রেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ এর ধারা ৭০ (১) সংশোধন করা হয়। এই আইনে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কল দিলে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। এমনকি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেও বিরক্তিকর কলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সত্যিকারের বিপদগ্রস্তদের দ্রুত সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে চালু করা হচ্ছে কলার লোকেশন ট্র্যাকার। এতে অপ্রয়োজনীয়, মিথ্যা তথ্য বা বিরক্তিকর কল কমে যাবে। ৯৯৯-এর কর্মী বাহিনী দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জনগণকে নির্বিঘ্নে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। দেশের সব মেট্রোপলিটন এলাকায় এমডিটি (মোবাইল ডাটা টার্মিনাল) ও টিডিএস (থানা ডেসপাস সিস্টেম) চালু করার ফলে সেবাটি আরও সহজ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৯৯৯ সেবা বর্তমানে একসঙ্গে ৮০টি কল রিসিভ করতে পারে। প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার কল আসছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই সার্ভিসযোগ্য কল। ৯৯৯-এর একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে ৪৩০ জন কর্মকর্তা জনগণের সেবায় কাজ করছেন। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের সঙ্গে সমন্বয় করে ৯৯৯-কে অটোমেশন করা হচ্ছে। এটি চালু হলে সময় কমে যাবে, দ্রুত সার্ভিস দেওয়া যাবে। রেসপন্স টাইম যত কম লাগবে, ততই দ্রুত জনগণকে সেবা দেওয়া যাবে। ৯৯৯-এর মূল লক্ষ্য জনগণকে অল্প সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া।
শিগগির অটো কলার লোকেশন ট্র্যাকার সংযুক্ত হচ্ছে। ফলে সেবাপ্রার্থী কল করলেই জানা যাবে অবস্থান, আর দ্রুত নিশ্চিত করা যাবে সেবা। তবে এক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির লোকেশন ট্র্যাকিং করা হবে না। যিনি ফোন করবেন শুধু তার লোকেশনটাই জানতে পারবে কর্তৃপক্ষ। ফোন করার পর ৯৯৯ থেকে শুধু জানতে চাওয়া হবে- সেবাপ্রার্থী কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। কোথা থেকে বলছেন এটা জানতে চাওয়া হবে না। এতে চার-পাঁচ মিনিট সময় বাঁচবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সামনে কালবৈশাখী ঝড় আসছে, প্রতি বছর এ সময় প্রচুর ফোন কল পায় ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ। ঝড়ে নদী কিংবা গভীর সমুদ্রে নৌযান আটকা পড়ে অনেকেই ৯৯৯-এ ফোন দেন। কিন্তু তারা সঠিক লোকেশন বলতে না পারায় উদ্ধার অভিযান দেরি হয়। অটো কলার লোকেশন চালু হওয়ার পর নদী কিংবা গভীর সমুদ্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ধার অভিযান সম্ভব হবে।
সূত্র বলছে, আগে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ঠাট্টা-তামাশা করতেন অনেকে। এ কারণে লাইন অনেক সময় ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু দিন দিন অযাচিত কলের সংখ্যা কমে এসেছে। এখন কোয়ালিটি কলের সংখ্যা বেড়েছে এবং সেবাগ্রহীতার কলের সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ, জনগণ এখন সচেতন হয়েছে। ৯৯৯ জরুরি নম্বর, এ নম্বরে ফোন করে ঠাট্টা-তামাশা করা যাবে না।
কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাদের বিপদের মুহূর্তে পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাচ্ছেন। শ্রেণি-পেশা ও সামাজিক অবস্থান, নির্বিশেষে নারী, শিশু, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীসহ সবাই পাচ্ছেন এ সেবা।
দিন দিন ৯৯৯-এর প্রতি জনগণের আস্থা বেড়েই চলছে। মানুষ যখনই বিপদে পড়ে তখনই ৯৯৯-এ ফোন দিচ্ছে। দক্ষ কর্মী বাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে জনগণকে সেবাটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। অটোকলার সিস্টেম চালু হলে সত্যিকারের ভুক্তভোগীদের আরও দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।