কুমিল্লায় ভুল চিকিৎসা দিয়ে অপারেশন থিয়েটারে রোগী রেখে ডাক্তার পালানোর ঘটনায় আটজনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত-১ এ লাকসাম উপজেলার মো: আব্দুল মালেক বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় মিডল্যান্ড হসপিটাল (প্রা:) লি: এর সার্জন ডা. নাজনীন আক্তার জাহান লুবনা, ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাব টেকনোলাজিস্ট, মেডিকেয়ার হসপিটাল (প্রা:) লি: -এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একই হাসপাতালের ল্যাব ইনচার্জ মো: ফাহাদ হোসেন, দেশ হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ওই হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু রোগ চিকিৎসক ডাক্তার হাবিবুর রহমান ও ল্যাব টেকনোলোজিস্টকে আসামি করা হয়েছে।
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন মাযহারী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মামলাটি জনস্বার্থে বিনা ফিতে পরিচালনা করছি। আদালত সিভিল সার্জনকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ভিকটিম বাদীর সম্পর্কে জেঠাস হন। ভিকটিম মোসাম্মৎ হাছিনা আক্তার নিতান্ত গরীব পরিবারে গৃহবধূ। তার স্বামী একটি মসজিদে ইমামতির চাকরি করে কোন রকম সংসার চালায়। তার ১৪ বছর বয়সের একটি প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। খুব অভাব অনটনের সংসারে থাকাকালীন চলতি বছরের ১ জানুয়ারি শারীরিক সমস্যা জরায়ুর টিউমার নিয়ে স্থানীয় মুদফ্ফরগঞ্জ মেডিকেয়ার হসপিটালে চিকিৎসা নিতে যান।
সেখানে ডা. নাজনীন আক্তার জাহান লুবনা ভিকটিমের সঙ্গে সমস্যা নিয়ে আলাপ শেষে কতিপয় পরীক্ষা দেন এবং মেডিকেয়ার হসপিটালে এসব পরীক্ষা করাতে বলেন। বাদী চিকিৎসকের কথা মতো ভিকটিমের সকল পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেখালে ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহান লুবনা অপারেশনের পরামর্শ দেন।
এক্ষেত্রে চিকিৎসক মেডিকেয়ার হসপিটালে অপারেশনের পরামর্শ দেন এবং একই হসপিটালে পুনরায় সকল পরীক্ষা করাতে বলেন। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি বাদী আত্মীয় স্বজন ও কতিপয় সাক্ষীদের আর্থিক সহযোগীতায় ভিকটিমের সকল পরীক্ষা করান। পরীক্ষায় মেডিকেয়ার হসপিটাল রোগীর রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ বলে রিপোর্ট প্রদান করেন। এরপর ১২ মার্চ মেডিকেয়ার হসপিটালে রোগীকে অপারেশনের শিডিউল দেন ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহান লুবনা।
ওইদিন বিকাল ৪টার পর রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো মেডিকেয়ার হসপিটালে ভর্তি করা হয়। এসময় অপারেশনের জন্য বি পজেটিভ রক্ত লাগবে বলে জানানো হয়। রোগীর স্বজন কথামতো বি পজেটিভ রক্ত ম্যানেজ করে।
এদিকে চিকিৎসকের পরামর্শে মিডল্যান্ড হসপিটালে পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করা হয় এবং সেখানেও রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ বলে মতামত দেওয়া হয়। এরপর ল্যাব টেকনোলোজিস্ট ভিকটিম এবং ডোনারের রক্তের ক্রসমেচিং করে। রাত আনুমানিক ৯:০০ ঘটিকায় ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহান লুবনা অপরেশন থিয়েটারে এসে অপারেশন শুরু করে।
অপারেশন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বলে আরো রক্ত লাগবে। দ্রুত ম্যানেজ করতে বলেন। তখন বন্ধু মহল ব্লাড ডোনেশন সোসাইটি সামাজিক সংগঠন তথ্য পেয়ে তাদের পক্ষ থেকে কয়েকজন জরুরী ভিত্তিতে ব্লাড ডোনেট করার জন্য ঘটনাস্থলে হাজির হয়।
ইতোমধ্যে হসপিটালের ব্লাডের কাজ করা সকল স্টাফ চলে যাওয়ায় রোগীর স্বজন দিশেহারা হয়ে দ্রুত ন্যাশনাল ব্লাড ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়ে রক্ত টানা ও ক্রসম্যাচিং করার কাজে লিপ্ত হয়। ন্যাশনাল ব্লাড ব্যাংক রোগীর রক্ত আর ডোনারের রক্ত ম্যাচ করতে না পারায় ৫ বার পর্যন্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর আরও কিছু ডোনার আনলেও কারও রক্তের সাথে রোগীর রক্ত ম্যাচ না করায় রোগীর স্বজন নিজ দায়িত্বে রোগীর রক্ত পাশ্ববর্তী অন্য এক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করে রোগীর রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ মর্মে নিশ্চিত হন।
ততক্ষণে অবশ্য ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহান লুবনা রোগীকে এক ব্যাগ বি পজেটিভ রক্ত জোরপূর্বক পুশিং করেন। ভিন্ন গ্রুপের ওই রক্ত রোগীর শরীরে পুশিং করাকালীন রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করায় ডাক্তার রক্ত পুশিং বন্ধ না করে চারজনকে দিয়ে হাতে পায়ে চাপ দিয়ে ধরে রোগীর শরীরে পুরো এক ব্যাগ ভুল রক্ত পুশিং করায়। ফলে রোগীর অবস্থার চরম অবনতি হয়।
এরমধ্যে রোগীর লোকজন রক্ত পরীক্ষা করে হসপিটালে আসলে ডাক্তার নাজনীন আক্তার জাহান লুবনাকে চলে যেতে দেখে ওনার পথরোধ করে রোগীর অবস্থা জিজ্ঞেস করায় তিনি রোগীকে ভুল রক্ত পুশিং করার কথা স্বীকার করেন। একইসঙ্গে রোগীর অবস্থা খারপ মন্তব্য করে রোগীর চিকিৎসা তিনি করতে পারবেন না বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
অথচ চিকিৎসক হিসেবে রোগীর প্রয়োজনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া একজন ডাক্তারের গুরু দায়িত্ব হলেও তিনি বেপরোয়া এবং তাচ্ছিল্যভাবে রোগীর অপারেশন পরিচালনা করেছেন। ডাক্তার বের হয়ে যাওয়ার সময় রোগীর মুত্রথলী দিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হচ্চিলো। এমতাবস্থায় তিনি রোগীকে রক্ষা করার কোন চেষ্টা না করে অপারেশন থিয়েটারে লাওয়ারিশের মত রোগীকে রেখে নির্দ্বিধায় চলে যান।
এরমধ্যে মিডল্যান্ড হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের লোকজন রোগীর সকল কাগজপত্র ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং হসপিটালের সকল লোকজন রোগীকে একা রেখে চলে যায়। রাত ১২:০০ ঘটিকা পর্যন্ত এমন চলাকালীন রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন হলে রোগীর লোকজন ও স্বেচ্ছসেবীগণ রোগীকে নিয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালের আইসিইউতে জরুরি ভর্তি করায়। সেখানে রোগী আইসিউতে ৫ দিন ভর্তি থাকার পর কিছুটা উন্নতি হলে তাকে বেডে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা খবর পেয়ে এ অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে প্রশ্ন করলে তারা রোগী এবং তার স্বজনকে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করবে মর্মে হুমকি দেয়। সর্বশেষ উক্ত চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নীরিক্ষার সাথে জড়িত আসামীগণ কৌশলে কুমিল্লা মেডিক্যাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে অন্যায়ভাবে উত্যক্ত করে অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে রিলিজ করিয়ে বাড়ীতে ফেরৎ পাঠায়। বর্তমানে রোগী প্রকৃত চিকিৎসাহীনভাবে বাড়ীতে মৃত্যু সজ্জায় অবস্থান করছে এবং মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার রোগীর যেকোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা হতে পারে মর্মে সতর্ক করেছেন।
এদিকে গত বছরের ১২ মে দেশ হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি: এর ডাক্তার হাবিবুর রহমানের নিকট মোসাম্মৎ মারিয়া আক্তার তার ৪৫ দিন বয়সী নবজাতক শিশু মিনহাজকে ঠান্ডা জনিত সমস্যার কারণে নিয়ে যায়। ডাক্তার মারিয়া আক্তারকে ভয় লাগায় এই মর্মে যে, তার হরমোনাল সমস্যা হয়েছে। তিনি ভিকিটমকে অন্যায় কমিশনের আশায় অপ্রয়েজনীয় ৫টি পরীক্ষার পরামর্শ দেন।
ডাক্তারের পরামর্শে ৬ নং দেশ হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি: এ ৩০০০ টাকা বিল পরিশোধ করে সেদিনই পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। এরপর ১৮ রিপোর্ট প্রদান করা হয়। রিপোর্টে দেয়া তথ্য মতে অন্যান্য রিপোর্ট স্বাভাবিক দেখালেও ২টির রেজাল্ট আসে যথাক্রমে ৩০ যার নরমাল ভেল্যু উল্লেখ ছিলো ৬৬-১৮১ এবং ৮.৫০ যার নরমাল ভেল্যু উল্লেখ ছিলো ০.৫-৫.০।
হসপিটাল ও ডাক্তারের কথা ও কাজে সন্দেহ পোষণ করে রোগী ২৯ মে ওই রিপোর্ট শিউর হওয়ার জন্য কুমিল্লা মেডিক্যালের শিশু বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার মো: জাভেদ ইকবালকে দেখালে তিনি দেশ হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি: প্রদত্ত রিপোর্ট এবং রোগীকে দেখে হতচকিত হয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং পুনরায় ওই পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন।
ওই দিনই জরুরী ভিত্তিতে কুমিল্লার ইবনে সিনা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করলে উক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট সম্পূর্ন স্বাভাবিক আসে। অথচ দেশ হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি: এর ডাক্তার ও রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে রোগীর চিকিৎসা দিলে নিশ্চিত রোগীর বড় ধরনের কোন সমস্যা হতো। এ বিষয়ে একই বছরের ২০ জুন দেশ হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডাক্তার হাবিবুর রহমানকে লিগ্যাল নোটিশ দিলে তারা কোন সদুত্তর দেননি। আইন আদালত সম্পর্কে তেমন অবগত না থাকায় তখন মারিয়া আক্তার মামলা করতে পারেন নাই।
আসামীগণ বাংলাদেশ মেক্যিাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ এর ২৩ ধারায় রেজিষ্ট্রেশন বাতিল হওয়ার মত অপরাধ করেছেন। পাশাপাশি দ্যা মেডিক্যাল প্র্যাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড লেবরেটরীজ (রেজুলেশন) অর্ডিনেন্স ১৯৮২ এর শিউিউল ক,খ,গ এর কতিপয় নীতিমালা লংঘন করেছেন।
এই মোকদ্দমার সকল ঘটনা এবং অপরাধের ধরণ অভিন্ন, আসামীদের এমন অপচিকিৎসা, অপটেস্ট, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট, চিকিৎসায় অবহেলার কারণে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে, পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এমনকি লক্ষ লক্ষ টাকা শেষ করে চিকিৎসা গ্রহণ করে সর্বশান্ত হচ্ছে বিধায় আদালতে জনস্বার্থে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে এ মোকদ্দমাটি দায়ের করা হলো। এ বিষয়ে বাদী ও সাক্ষীগণ থানায় গেলে থানা কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয় বিধায় বাদী আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করলেন।