মামলাজট বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অন্তরায় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। মুন্সীগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির ১৭৮ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বুধবার (৫ জুলাই) তিনি এ কথা বলেন।
আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আদালত বয়কটের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বারবার ভাববেন কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, রাষ্ট্র না বিচার বিভাগ, আইনের শাসন না মানুষের মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি না বিচারপ্রার্থী জনগণ।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন হচ্ছে মহাসমুদ্রের মতো। সবার পক্ষে সব আইন জানা সম্ভব নয়। আইনজীবীদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনাদের হৃদয় যেন কখনো শক্ত না হয়। আপনাদের মেজাজ যেন কখনো ক্লান্ত হয় না। আচরণই আপনাদের স্থান ঠিক করে দেবে।
এ সময় তিনি আরো বলেন, প্রিয় আইনজীবীবৃন্দ আমাদের মনে রাখতে হবে আদালতে যারা বিচার চাইতে আসে তারাও আমাদের মতো মানুষ। আমাদের সবার উচিত তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা। মানবতা নিজের ভেতরটাকে ভালো করে দেয়। যে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলীর প্রকাশ যত বেশি তিনি তত অনুকরণীয় অন্যদের কাছে। জীবনের অর্থই হলো মানবতার সেবা করা। আপনারা মানবতার কথা মনে রাখবেন, আর সব কিছু ভুলে গেলেও চলবে। মানুষের হৃদয়ে নিজেদের জায়গা করে নেবেন নিজেদের আলোকিত করবেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলাজট বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অন্তরায়। অধিকাংশ ফৌজদারি বিরোধের উৎপত্তি ভূমি বিরোধ থেকে। অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য পরিহার করে দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দেওয়ানি বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে মামলা জটে বিচার বিভাগ সংবিধান প্রতিশ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
মুন্সীগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. জাকারিয়া মোল্লার সভাপতিত্বে ও অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার গোলাম রাব্বানী, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ কাজী আব্দুল হান্নান, মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল, মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন, আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মাসুদ আলম, আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আর্শেদ উদ্দিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান, অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন (পিপি) প্রমুখ।
এ সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফয়েজুন্নেছা, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া রহমানসহ অন্যান্য বিচারক ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
মুন্সীগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে ‘ন্যায়কুঞ্জ’ উদ্বোধন
এর আগে প্রধান বিচারপতি আদালতে আসা বিচার প্রার্থীদের বিশ্রামের জন্য আদালত প্রাঙ্গণে ‘ন্যায়কুঞ্জ’ উদ্বোধন করেন।
ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যে যতটুকু অপরাধ করবে, তার ঠিক ততটুকু শাস্তি পেতে হবে। তা যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আইনের শাসন, গণতন্ত্র—কিছুই প্রতিষ্ঠিত হবে না।’
বিচারব্যবস্থা ফেইল করলে গণতন্ত্র ফেইল করবে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘গণতন্ত্র ফেইল করলে রাষ্ট্র ফেইল করবে। এ কারণে বিচারব্যবস্থা ঠিক রাখতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি জানিয়ে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এখন ১৭ কোটি মানুষের দায়িত্ব দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করবো। এ জন্য আমাদের যেটি দরকার, তা হলো রাষ্ট্রের অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিচারব্যবস্থাকে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’
সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয় জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারকদের পাশাপাশি আইনজীবীদের দায়িত্ব আছে। দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা বিচারব্যবস্থা যাতে এগিয়ে নিতে পারি—সে চেষ্টা সবাইকে করতে হবে। একে-অপরকে সহযোগিতা করবেন, যাতে বিচারপ্রার্থীকে আদালতে এসে হয়রানির শিকার হতে না হয়। যদি কোনও মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে, তাহলে বিচারপ্রার্থীরা ভাববে, দেশে বিচার-আচার নেই। এটাই বিচার বিভাগের জন্য হবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এটি আমরা হতে দিতে পারি না।’