কে এম মশিউর রহমান: বর্তমান বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে সকল সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে অনলাইন জুয়া। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত মানুষ, এবং শিশু কিশোরদের মাঝে এই প্রবণতা আশংকা জনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 1x bet, অনলাইন ক্যাসিনো, অনলাইন লুডু জুয়া সহ বিভিন্ন ফর্মেটে চলেছে জুয়া খেলা। জোঁক যেমন গায়ে লাগলে সমস্ত রক্ত শুষে নেয় ঠিক অনলাইনে জুয়াও ব্যক্তির জীবনকে শুষে ফেলে।
জুয়া বা বাজি হচ্ছে এমন একটা খেলা যা লাভ বা লোকশানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে। ইসলাম ধর্ম ও বাংলাদেশের আইনে জুয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আজকের এই লেখায় আমরা অনলাইন জুয়ার কারণ, এর ইসলামিক দৃষ্টিকোণ, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং প্রতিকার সম্পর্কে জানব।
অনলাইন জুয়ার কারণ
অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদ পাতা হয়। লোভ দেখানো হয় এক দিনেই লাখপতি হওয়ার! ঘরে বসেই যদি লাখ লাখ টাকা উপার্জন করা যায় তবে ক্ষতি কি! এমন ধারণা থেকেই এসব জুয়া খেলার সাইটে যুক্ত হয়ে সর্বস্ব হারাতে হচ্ছে। জুয়ার সাইটে যুক্ত হতে প্রথমেই দিতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ। সেই টাকায় ডিজিটাল কয়েন কিনে ধরতে হয় ‘বাজি’।
প্রথম দিকে বাজির টাকায় যখন দুই তিন গুণ টাকা ফেরত আসে, তখন বাড়তে থাকে লোভ। যেভাবেই হোক আরো টাকা জোগাড় করে আবার ধরা হয় বাজি। কিন্তু হেরে গেলে সব টাকাই জলে! তখন টাকা উদ্ধারের জন্য আবারো আরো টাকা জোগাড় করে বাজি ধরার চক্রে পড়ে নিঃস্ব হতে হয়।
জুয়া আসক্তির কারণ ও এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন,”জুয়ার আসক্তি হলো- জুয়া খেলার জন্য মনের ভেতর অসম্ভব ও অনিয়ন্ত্রিত এক ধরনের চাহিদার সৃষ্টি হওয়া। সেই চাহিদা পূরণ না করে থাকা অত্যন্ত কঠিন। এই চাহিদাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যেকোনো কিছুর বিনিময়েই আসক্ত মানুষটি সেই চাহিদা পূরণ করতে চায় এবং জুয়া খেলতে চায়।”
অর্থাৎ এখানে অর্থের চেয়ে মানসিক শান্তি বেশি গুরুত্ব পায়।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ অনুসারে
জুয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়াকে হারাম এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। তুমি বলো এ দুটিতে রয়েছে মহাপাপ’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২১৯)। যেহেতু স্পষ্ট কোরআনে ইনজানকশন রয়েছে তাই বলা যায় যেকোনো মুসলিমের জন্য জুয়ার আশেপাশে যাওয়া মহাপাপ।
দেশের প্রচলিত আইনে কি বলে?
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ এর সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধ করা হয়। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু কি ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে তার কোন সুস্পষ্ট কথা উল্লেখ নেই।
বাংলাদেশের জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এ আইন ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য।
পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭, সেকশন ৩ অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ সেকশন ৪ অনুযায়ী, কোনও ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনও ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
অর্থাৎ এই আইন শুধুমাত্র প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং দণ্ডবিধি বর্তমান বাস্তবতার সাথে উপযোগী নয়।
তবে আশার কথা হচ্ছে জুয়া প্রতিরোধে নতুন আইন করছে সরকার। এজন্য নতুন ‘জুয়া আইন, ২০২৩’ এর খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মূলত ১৮৬৭ সালের ‘দ্য পাবলিক গ্র্যাম্বলিং অ্যাক্ট’ যুগোপযোগী করে নতুন আইনটি করা হচ্ছে।
খসড়া আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আগের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ২০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল। আশা করছি দ্রুত আইনটি কার্যকর হবে এবং এর সঠিক প্রয়োগ হবে।
অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে করণীয়
সত্যি বলতে আইন প্রয়োগ করে অনলাইন জুয়া চিরতরে বন্ধ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ ডিজিটালাইজেশন এর কারণে এটি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং এটি নিজের বাড়ি বসেই খেলা যায় তাই এখানে আইন প্রয়োগ করা কঠিন। অনলাইন জুয়া প্রতিরোধের জন্য পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিটিআরসি নিয়মিত তদারকি করে জুয়ার সকল সাইট বন্ধ করে দিতে পারে।
পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব এ কোন কোন কনটেন্ট দেখতে গেলে বিভিন্ন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন চলে আসে। ফলে যারা এ সম্পর্কে জানে না তারাও এতে জড়িত হয়ে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে এবং এক জিনিস বারবার দেখতে দেখতে মানুষ কৌতুহল বশত তো এটিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই সকল বেটিং সাইটের প্রমোশন বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।