আসামি পক্ষে আইনজীবী না দাঁড়ানো নিতান্তই আবেগী, ন্যায়বিচার পরিপন্থী
মোঃ সাহিদ ইসলাম, আইন শিক্ষার্থী

বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও আটক – এক ভয়ানক গণ আতংক

মোঃ সাহিদ ইসলাম: সমাজে বাস করতে গেলে মানুষকে বিভিন্ন নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রণীত অথবা প্রচলিত যেসকল নিয়ম-কানুন কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী নিজেদের উপর বাধ্যগত বলে স্বীকার করে সহজ কথায় সেগুলোকে আইন বলা যায়। সমাজে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার জন্যই এইসব আইন কানুন প্রণীত হয় এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে বিচারের মাধ্যমে তার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও রাখা হয়।

ন্যায়বিচার এর মাধ্যমে আইন ভঙ্গকারীকে শাস্তি দেয়ার জন্য তাকে উপযুক্ত আদালতে হাজির করতে গ্রেফতার এর প্রয়োজন পরে। আর আমাদের দেশে আইন ভঙ্গকারীর বিচার করে তাকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করার ক্ষমতা টা দেয়া হয়েছে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা পুলিশ বাহিনী কে। কিন্তু তাই বলে কি পুলিশ মন চাইলে যে কাউকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারে? বা পুলিশ কখন একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারে?

সাধারণত কারো বিরুদ্ধে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকলে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। আইন অনুযায়ী সাধারণত গ্রেফতারী পরোয়ানা ব্যতীত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর বিশেষ ক্ষমতা পুলিশকে দেয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ৫৪, ৫৫, ৫৭ ধারায় এই বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হলেও এদের মাঝে ৫৪ ধারা বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতার মূল উৎস, যা পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর ক্ষেত্রে এক সুবিশাল ক্ষমতা প্রদান করেছে।

বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার যেমন আইন সঙ্গত তেমনি অনেক সময় রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে এর ব্যবহার হয়। এজন্য আমাদের দেশে প্রচলিত আইন, পবিত্র সংবিধান, মানবাধিকার এর দলিল, ও উচ্চ আদালতের মাধ্যমে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির বেশ কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠিত আছে। আজকে আমরা বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর বিধান এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করব।

বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার

আগেই উল্লেখ করেছি যে, আইন অনুযায়ী সাধারণত গ্রেফতারী পরোয়ানা ব্যতীত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর বিশেষ ক্ষমতা পুলিশকে দেয়া হয়েছে । ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৫৪,৫৫,৫৭ ধারায় এই বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

তো দেখা যাক এই ধারা গুলোতে কোন কোন ক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে! এই বিষয়ে প্রথমেই আসে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা, যা পুলিশের বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর এক সুবিশাল ক্ষমতা! এই ধারা অনুযায়ী ৯ টি ক্ষেত্রে পুলিশ কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে; যথা-

১। কোন গুরুতর আমলযোগ্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে অথবা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে এমন ব্যক্তিকে।

২। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া যার নিকট ঘর ভাঙার সরঞ্জাম রয়েছে!

৩। ফৌজদারী কার্যবিধি অথবা সরকারের আদেশ দ্বারা যাকে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

৪। এমন কোন ব্যক্তি যার নিকট চোরাই মালামাল রয়েছে বা আছে বলে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে।

৫। পুলিশের কাজে বাধাদানকারী ব্যক্তি।

৬। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে পলায়নকারী ব্যক্তি।

৭। বাংলাদেশের বাইরে কোন অপরাধ করে আসলে সেই কাজ বাংলাদেশে অপরাধ বলে গণ্য হলে, অপরাধকৃত ব্যক্তি।

৮। কোন মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬৫(৩) ধারা লঙ্ঘন করলে এবং

৯। অন্য কোন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে, যে ব্যক্তিকে গ্রেফতার এর অনুরোধ করা হয়েছে ।

এছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫ ধারায়, থানার ওসি সাহেব ৩ শ্রেণীর ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ হলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন;

১। এখতিয়ারাধীন এলাকার মধ্যে গুরুতর অপরাধ করে এসে আত্মগোপনকারী ব্যক্তি।
২। ভরণপোষণের জন্য প্রকাশ্য কোন জীবিকা নেই এমন ব্যক্তি।
৩। চোর বা ডাকাত হিসেবে পরিচিত এমন কোন ব্যক্তি।

একই আইনের ধারা ৫৭(১) ধারা অনুযায়ী পুলিশ অফিসারের সামনে কেউ আমলঅযোগ্য অপরাধ করলে সেই অপরাধীর নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পর সে যদি তার আসল নাম ঠিকানা না জানায় তাহলে নাম ঠিকানা যাচাই করার জন্য তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়।

তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, “গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সঠিক নাম ঠিকানা পাওয়া গেলে এবং উপযুক্ত মুচলেকা প্রদান করলে তাকে তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিতে হবে। [AIR 1919 All 160]”

এরপরে, “ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৯(১) ধারা জনসাধারন বা বেসরকারি ব্যক্তি দুইটা ক্ষেত্রে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেঃ

১। তার সামনে কেউ আমলযোগ্য এবং জামিন-অযোগ্য অপরাধ করলে এবং
২। সরকার কর্তৃক অপরাধী ঘোষিত কোন ব্যক্তিকে।
মনে রাখতে হবে, বেসরকারি ব্যক্তি কাউকে সন্দেহের বশে গ্রেফতার করতে পারেনা।

ধারা ৬৪ অনুযায়ী, কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে এবং তার এখতিয়ারাধিন এলাকার মধ্যে কেউ অপরাধ করলে তিনি তাকে নিজে গ্রেফতার করতে পারেন অথবা অন্য কাউকে গ্রেফতার এর নির্দেশ দিতে পারেন।

এছাড়াও পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১২৮,১৫১ ও ৪০১(৩) ধারার অধীনে এবং বিভিন্ন বিশেষ আইনের অধীনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে।

৫৪ ধারার অপব্যবহারের হাতিয়ার ‘যুক্তিযুক্ত সন্দেহ’ এবং উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা

ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বর্ণিত ক্ষেত্রগুলোতে পুলিশ যুক্তিসংগত সন্দেহের ভিত্তিতে যে কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। যদিও এই “যুক্তিসংগত সন্দেহ”- শব্দটার কোন ব্যাখ্যা এই আইনে নেই। ফলে পুলিশ এই ধারায় কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রনহীন’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে। ক্ষমতার অপব্যবহার সবচেয়ে বেশী দেখা যায় যখন কোন ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করার পরে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ৩ ধারায় নিবর্তনমূলক আটক আদেশ প্রদান করা হয়।৷

৫৪ ধারায় “যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ” শব্দটার স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায়, এটির অপব্যবহার এর বিস্তৃত সুযোগ থাকলেও, আমাদের মহামান্য উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে এখন এই বিষয় টা স্পষ্ট। ৫৪ ধারায় সন্দেহের ব্যাখ্যা কি হবে তা মহামান্য উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিন্মে পর্যালোচনা করা হলোঃ

এই বিষয়ে “সাইফুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র” মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন “যৌক্তিক সন্দেহ” কি সেটা নির্ভর করে প্রতিটি মামলার পরিস্থিতির উপর, তবে এটি অন্ততপক্ষে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত যা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দিকে সন্দেহ ছুঁড়ে দেয় এবং এটি কোনভাবেই কোন অস্পষ্ট অনুমানের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত নয়।

আদালত আরও বলেন, “‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ’ এবং ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ অবশ্যই নির্দিষ্ট তথ্যের সাথে সম্পর্কিত, যা এই বিধানের অধীনে একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার আগে পুলিশ অফিসারকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। অন্য কথায়, এই ধরনের তথ্য প্রাপ্তির পর পুলিশ অফিসারের অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং আন্তরিক বিশ্বাস থাকতে হবে যে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা সংঘটিত হতে চলেছে, এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন।

আলহাজ্ব মোঃ ইউসুফ আলী বনাম রাষ্ট্র মামলায়, হাইকোর্ট বিভাগ ৫৪ ধারার অধীনে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘যৌক্তিক সন্দেহ’ ব্যাখ্যা করে বলেন, পুলিশ অফিসারের অবশ্যই আন্তরিক বিশ্বাস থাকতে হবে যে একটি অপরাধ ইতিমধ্যেই সংঘটিত হয়েছে বা হতে চলেছে। আদালত আরও বলেছে যে একজন পুলিশ অফিসার অন্যায়ভাবে একজন ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি এবং প্রকৃত বিশ্বাস ছাড়া গ্রেপ্তার করলে দণ্ডবিধির ২২০ ধারার অধীনে অপরাধ সংঘটিত করে।

ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় আদালত বলেন, ‘যুক্তিযুক্ত সন্দেহ’ বলতে বোঝায় যে সন্দেহ অবশ্যই কোন কারণের উপর ভিত্তি করে হতে হবে এবং কারণগুলি এমন কিছু সত্যের অস্তিত্বের উপর ভিত্তি করে যা সেই ব্যক্তির (পুলিশ অফিসার) জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে। তাই পুলিশ অফিসার যখন ওয়ারেন্ট ছাড়াই একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে, তখন তার অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট তথ্যের জ্ঞান থাকতে হবে যার ভিত্তিতে তিনি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ করতে পারেন।”

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার

পুলিশের স্বেচ্ছাচারীভাবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর সময় বেশিরভাগ ই দেখা যায়, সিভিল পোশাকে থাকে, আবার পরিচয়পত্র দেখায় না, গ্রেফতারের কারণ জানায় না এমনকি গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের ও আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করতে দেয়না। এছাড়াও বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এর নামে হয়রানি করে বিশেষ হাদিয়া! নেয়ার ঘটনা ও আমাদের দেশে পরিচিত একটা ঘটনা। পুলিশের এধরনের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ বা মোকাবেলা করে প্রতিকার পাওয়ার ক্ষমতা ধনী ও প্রভাবশালীদের থাকলেও গরিব জনগণের সেই ক্ষমতা থাকেনা । ফলে গরিব জনগণই এর নির্মম শিকার হয় বেশিরভাগ সময়।
আমাদের পবিত্র সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি, মানবাধিকারের দলিল এবং উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠিত।

১। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষনাপত্র ১৯৪৮ এর ৯ ধারা মতে কাউকে খেয়াল খুশিমত গ্রেফতার, আটক বা নির্বাসন করা যাবে না।
২। যাকে গ্রেফতার করা হবে তার নাম ঠিকানা যাচাই করে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে। ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৪৬, পিআরবি বিধি ৩১৬
৩। গ্রেফতারকারী পুলিশ অফিসার প্রথমেই নিজের পরিচয় দিবেন। (পিআরবি বিধি ২২০)
৪। যাকে গ্রেফতার করা হবে গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে তাকে অবগত করাতে হবে। (বাংলাদেশ সংবিধান ৩৩ অনুচ্ছেদ। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৮০, ৪৬ ধারা।)
৫। জরুরী বা সেবামূলক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে গ্রেফতার সময় তার বদলী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পিআরবি বিধি ৩১৮।
৬। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে দৈহিক মারধর, আঘাত করা বা নির্যাতন করা যাবে না। বাংলাদেশ সংবিধান ৩৫ অনুচ্ছেদ, পুলিশ আইনের ২৯ ধারা, দণ্ডবিধি আইনের ৩৩০ ৩৩১ ধারা।
৭। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মহিলা, অতিবৃদ্ধ কিংবা দুর্বল হলে হাতকড়া লাগানো যাবে না। পিআরবি বিধি ৩৩০, ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৭১ ধারা।
৮। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি অসুস্থ্য হলে উপযুক্ত চিকিৎসা পাবার এবং খাদ্য ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে। পিআরবি বিধি ৩২১ ও ৩৩৩। ৯। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দেহ তল্লাশির পর প্রাপ্ত দ্রব্যাদি জমা রেখে তাকে একটি রশিদ প্রদান করতে হবে। পিআরবি বিধি ৩২২, ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫১ ধারা।
১০। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মহিলা হলে তার শালীনতার প্রতি খেয়াল রেখে অপর কোন মহিলা বা মহিলা পুলিশ দিয়ে দেহ তল্লাশি করাতে হবে। পিআরবি বিধি ৩২২, ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫২ ধারা।
১১। থানার হাজতখানায় একজন বন্দীর জন্য কমপক্ষে ৩৬ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে। পিআরবি বিধি ৩২৭
১২। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির প্রকাশ্য আদালতে দ্রুত বিচার পাবার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান ৩৫ অনুচ্ছেদ।
১৩। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবে না। বাংলাদেশ সংবিধান ৩৫ অনুচ্ছেদ।
১৪। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৭ (২) ধারা মতে নাম ঠিকানা সঠিক হলে আসামীকে মুক্তি দেয়া যাবে।
১৫। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৯(৩) ধারা মতে আসামী কোন অপরাধ করেছে বলে যথেষ্ট কারণ না থাকলে তাকে তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিতে হবে।
১৬। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৬৩ ধারা মতে অভিযুক্তকে ভয় দেখানো যাবে না।
১৭। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৬৪ (৩) ধারা মতে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করা যাবে না। বাংলাদেশ সংবিধান ৩৫ (৬) অনুচ্ছেদ।
১৮। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৪৯৬ ধারা মতে জামিনযোগ্য অপরাধ হলে জামিন দিতে হবে।
১৯। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় পৌঁছানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকততম ম্যাজিট্রেটের কাছে উপস্থিত করতে হবে। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৬১, ৮১ ধারা।
২০। ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ ছাড়া কোন ক্রমেই ২৪ ঘন্টার বেশি আটক রাখা যাবে না। ফৌজদারী কার্যবিধি, ৬১ এবং ১৬৭ ধারা।

স্বেচ্ছাচারী গ্রেফতার ও আটক এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা

গ্রেফতার এর নিয়ম এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার এর বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলা যা ৭ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর বেঞ্চ রায় প্রদান করেন [৫৫ ডিএলআর (এইচসিডি)(২০০৩) ৩৬৩] এবং সাইফুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র মামলা যা বিচারপতি এসকে সিনহা ও বিচারপতি শরীফউদ্দিন চাকলাদের এর বেঞ্চ রায় প্রদান করে।

এই মামলার রায়ে উচ্চ আদালত গ্রেফতার, আটক ও রিমান্ড সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা এখানে গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কিত নির্দেশনা গুলো দেখবো। উক্ত মামলায় গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা গুলো হলো-

১. ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশন বা আটকাদেশ দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবেন না।

২. কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ অফিসার তাঁর পরিচয় প্রদান করবেন এবং প্রয়োজনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিসহ উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিকেও তার পরিচয়পত্র দেখাবেন

৩. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় আনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার দ্রুত গ্রেফতারের কারণসমূহ থানার রাখা কেস ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করবেন। যেমন- আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য; অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ, যে পরিস্থিতিতে গ্রেফতার করা হয়েছে; তথ্যের উৎস এবং তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণ; স্থানের বর্ণনা, সময় ও গ্রেফতারের সময় ও তারিখ এবং গ্রেফতারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিগণের নাম ঠিকানা ।

৪. যদি গ্রেফতারের সময় পুলিশ অফিসার গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তাহলে তিনি আঘাতের কারণ লিখবেন এবং তাকে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতাল বা সরকারি চিকিৎসকের কাছে নিবেন এবং চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তারের সনদ নিবেন।

৫. থানায় আনার তিন ঘন্টার মধ্যে পুলিশ অফিসার গ্রেফতারকৃতকে গ্রেফতারের কারণ জানাবেন।

৬. বাসস্থান বা কর্মস্থল ছাড়া অন্য কোন স্থান থেকে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে, গ্রেফতারকৃতকে থানায় আনার এক ঘন্টার মধ্যে পুলিশ তার আত্মীয়-স্বজনকে টেলিফোনে বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত গ্রেফতারের সংবাদটি জানাবেন।

৭. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দমত আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দিবেন।

৮. পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারলে পুলিশ কর্মকর্তা ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারা অনুযায়ী প্রদত্ত ফরোয়াডিং-এ ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারার কারণ এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্য কেন সঠিক তা বর্ণনা করবেন। একই সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা এ সংক্রান্ত মামলার ডাইরী সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করবেন।

৯. যদি ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রেরণকৃত পত্রে ও মামলার লিখিত ডাইরীর বর্ণণা পড়ে সন্তুষ্ট হন যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যগুলো যুক্তিসংগত এবং তাকে জেলে রাখার যথেষ্ট উপকরণ মামলার ডাইরীতে রয়েছে, তবে তিনি গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেবেন, অন্যথায় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মুক্তি দেবেন।

১০. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ যুক্তিসংগত না হওয়ায় এবং তাকে জেলে রাখার যথেষ্ট উপকরণ মামলার ডাইরীতে না থাকায় যদি ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দেন, তবে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯০ (১) (গ) ধারায় উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম শুরু করবেন। একই সঙ্গে ওয়ারেন্ট ছাড়া উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার কারণে ঐ পুলিশ অফিসার ২২০ ধারা অনুযায়ী বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে বা উৎকোচ গ্রহণ করে উক্ত ব্যক্তিকে আটক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।

প্রতিকার

১। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-

২০১৩ সালে সংসদ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন পাশ করে। এই আইনে ব্লাস্টের মামলায় প্রদত্ত সুপারিশের ভিত্তিতে কতিপয় বিধান অর্ন্তভুক্ত করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ কর্তৃক নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ পাশ হয়।

এই আইন অনুযায়ী, ‘নির্যাতন’ অর্থ কষ্ট হয় এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: তথ্য বা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য সন্দেহভাজন অথবা অপরাধী কোন ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান, ভয় ভীতি দেখানো এবং পক্ষপাতমূলকভাবে কোনো প্ররোচনা বা উস্কানি বা কারো সম্মতিক্রমে কোন সরকারী কর্মকর্তার নিজ ক্ষমতাবলে বা সরকারী ক্ষমতাবলে এইরূপ কার্যকলাপ নির্যাতন বলে গণ্য হবে ।”

আবার ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ বলতে পুলিশ, র‍্যাব, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, বিজিবি, শুল্ক বিভাগ, ইমিগ্রেশন, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ও কোস্টগার্ডকে চিহ্নিত করবে। এবং অপরাধসমূহ আমলযোগ্য; আপোষ ও জামিনের অযোগ্য।

২। যদিও, দন্ডবিধির ৩৩০ ধারায় কোন ব্যক্তির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি বা তথ্য আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগ বা আঘাত করা এবং ৩৪৮ ধারায় স্বীকারোক্তি বা তথ্য আদায়ের জন্য বেআইনীভাবে আটক রাখার বিষয়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু কোন ব্যক্তি কারাগার বা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি ওই ধারাগুলোতে উল্লেখ নেই।

কিন্তু উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, একজন পুলিশ অফিসার অন্যায়ভাবে একজন ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি এবং প্রকৃত বিশ্বাস ছাড়া গ্রেপ্তার করলে দণ্ডবিধির ২২০ ধারার অধীনে অপরাধ সংঘটিত করে।

৩। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রিট দ্বায়ের করার মাধ্যমে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারে

মন্তব্য

বাংলাদেশে এখনো প্রায়শই নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক বা নির্যাতন চলছে। এটি রোধ করতে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ ও সাইফুজ্জামান বনাম বাংলাদেশ মামলায় দেয়া হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক ও নির্যাতনের দায়মুক্তিও বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের বিষয়ে মানবাধিকার এবং প্রাসঙ্গিক আইনি সুরক্ষার জ্ঞানের অভাব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম প্রধান কারণ।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে মানবাধিকার আইনকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। সর্বোপরি, সকলের সম্মিলিত চেষ্টা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই হয়তো এই ভয়াবহ রোগ থেকে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তি পাবে।

সবশেষে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই-

“রুখো দুর্নীতি, পুলিশি হয়রানি,
আইন অঙ্গন থেকে আওয়াজ উঠুক, দলে দলে বেধে ঝাক,
সংবিধানের জয়গান হোক, মোরাল পুলিশিং নিপাত যাক।”

লেখক: মোঃ সাহিদ ইসলাম, আইন শিক্ষার্থী ও সাধারণ সম্পাদক, জাস্টিস সার্ভড ফাউন্ডেশন।

গ্রন্থপঞ্জীঃ
১। ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ, ৫৫ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ৩৬৩ পেজ।
২। ব্লাস্ট কতৃক প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট (ব্লাস্টের ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত)।
৩। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট এবং রিসার্চ পেপার।
৪। বিভিন্ন পত্রিকা ও ওয়েব পোর্টালের নিউজ।
৫। বিচারপতি ওয়াহাব এর লেখা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বই।