আবদুল্লাহ আল আশিক: শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের দীর্ঘ ৩৭ দিনের ছুটি শুরু হয়েছে। প্রায় সময় অনেককেই বলতে শুনি, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগণ এত ছুটিতে কেনো থাকেন? সুপ্রীম কোর্টের এত ভ্যাকেশন কেনো দরকার? বছরে তো ছয় মাসই দেখি সুপ্রীম কোর্ট বন্ধ থাকে, ব্যাপারটা কি? এই রকম অসংখ্য প্রশ্নই শোনা যায়। ছুটির পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক যুক্তিতর্কও উদিত হয়। এমন প্রশ্নও শোনা যায়, যে দেশে মামলার জট এত বেশি সে দেশের সুপ্রীম কোর্টের এত ভ্যাকেশন কি মানায়?
প্রকৃতপক্ষে শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর প্রায় সব এপেক্স কোর্টই ভ্যাকেশন পালন করে থাকেন। যেমন, ইন্ডিয়ার প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় এর বক্তব্য থেকে জানা যায়, আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট এর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই ঐদেশের সুপ্রীম কোর্ট মাসে মাত্র ৮ থেকে ৯ দিন বসেন। বছরের হিসেব করলে বসে ৮০ দিন।
অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র ৮০ দিন আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টের রেগুলার কার্যক্রম পরিচালনা হয়। আবার যদি আমরা অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্ট এর দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই সে দেশে হাইকোর্ট বসে মাসে মাত্র ২ সপ্তাহ, অর্থাৎ বছরে ১০০ দিনেরও কম কোর্টের কার্যক্রম পরিচালনা হয়।
এভাবে সিঙ্গাপুরের এপেক্স কোর্ট বছরে মাত্র ১৪৫ দিনের বেশি কার্যক্রম পরিচালনা করেন না। আবার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতেও সুপ্রীম কোর্টের কার্যক্রম হয় বছরে মাত্র ২০০ দিনেরও কম। সেখানে আমাদের বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৮৩ দিন রেগুলার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।
মূলত ভ্যাকেশন বলতে আমরা কোর্ট কার্যক্রমের ছুটি বুঝলেও, প্রকৃতপক্ষে মাননীয় বিচারপতিদের ছুটি বোঝায় না। অর্থাৎ একজন বিচারক এই দীর্ঘ ভ্যাকেশনে ঘুরে ফিরে ও আড্ডাবাজি করে সময় পার করবেন ব্যাপারটি আসলে এমন নয়। সুপ্রীম কোর্টের এমন ভ্যাকেশন গুলো নির্ধারণ করা হয়েছে মাননীয় বিচারপতিগণের আইন চর্চা, কেস স্টাডি, দেশ ও জাতির কল্যাণে নতুন কিছু সংযোজন করার জন্য। প্রত্যেক বিচারপতিগণ এইসব ভ্যাকেশনে বিভিন্ন মামলার জাজমেন্ট লিখে থাকেন। আইন ও ইকুইটি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন।
আমরা আপাতত দৃষ্টিতে দেখতে পাই, একজন বিচারপতি প্রতিদিন সকাল ১০.৩০ থেকে বিকেল ৪.০০ ঘটিকা পর্যন্ত কোর্টে বসেন। মামলা শোনেন। নিষ্পত্তি করেন। এরপর তিনি হয়তো সম্পূর্ণ দায়মুক্ত হয়ে যান। কিন্তু পর্দার আড়ালে একজন বিচারপতি যে পরিমাণ অমানবিক পরিশ্রম করেন সেটা হয়তো আমরা কেউ-ই উপলব্ধি করতে চাই না।
একজন মাননীয় বিচারপতি প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা পরিশ্রম করে থাকেন। প্রত্যেক বিচারপতি মহোদয় অবশ্যই এই অমানবিক পরিশ্রম এর সম্মুখীন হন। এছাড়া যেকোনো আইনের জটিলতা নিরসনে একজন বিচারপতি মহোদয়ের অধ্যবসায় অপরিসীম। সুতরাং মস্তিষ্কের স্থির চিন্তা ও মামলার সঠিক রায় প্রকাশের জন্য প্রত্যেক দেশেই সুপ্রীম কোর্টের ভ্যাকেশন বা অবকাশ একটি অনিবার্য বিষয়।
তাছাড়া আমরা দেখতে পাই, সুপ্রীম কোর্টের প্রত্যেক ভ্যাকেশনেই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মহোদয় ভ্যাকেশন কোর্ট বা অবকাশকালীন কোর্টের ব্যবস্থা রাখেন। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ মামলা গুলো পরিচালনা করা যায়।
সুতরাং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ভ্যাকেশন বা অবকাশ বলতে আদালত কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ বোঝালেও, প্রকৃতপক্ষে বিচারপতি মহোদয়গণের অবকাশ বোঝায় না। তাঁরা সর্বদা মামলার জটিলতা অবসান ও আইনী সমাধান খুঁজতেই কর্মমুখর থাকেন।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।