কর্মস্থল, এয়ারপোর্ট, বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, শপিংমলের মতো জনসমাগমস্থলে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও ব্যবস্থাপনায় বিধিবদ্ধ, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
আজ মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ ৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে প্রথম ৯ মাসের কোনো শিশুর রিটে এই রায় দিয়েছেন এই দুই বিচারক।
আদালতে রায়ের পর্যবেক্ষণে এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আদালতে উপস্থাপনের জন্য পিটিশনার আইনজীবী ইশরাত হাসানকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। রায়ের শেষে আদালত উল্লেখ করেন, এর আগে কখনোই ৯ মাস বয়সী শিশু রিট দায়ের করেনি। এই শিশু ইতিহাস সৃষ্টি করলো।
হাইকোর্ট রায়ে বলা হয়েছে, শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পানের বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একটি শিশুর জন্মের পর থেকে ২ বছর পর্যন্ত তার মাতৃদুগ্ধ প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মায়েরা সরকারি-বেসরকারী বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং রুমের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
রায়ের বিষয়ে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘মা ও শিশুদের অধিকার রক্ষায় এটি একটি যুগান্তকারী রায়। আমাদের সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদে স্বীকৃত অন্যতম মৌলিক অধিকার জীবনের অধিকার বিষয়ে এ রায় নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রায়। উচ্চ আদালতে আমার ও আমার শিশু সন্তানের চার বছরের আইন লড়াই স্বার্থক হয়েছে। আদালত রায়ে আমাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এর আগে চলতি বছরের ২ এপ্রিল এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট তানজিলা রহমান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান।
বিগত ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নিরাপদে মায়ের বুকের দুধ পানের পরিবেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে ৯ মাস বয়সের ছোট্ট শিশু উমাইর বিন সাদী। সাথে ছিল তার মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
রিট আবেদনে কর্মক্ষেত্র, শপিংমল, এয়ারপোর্ট, বাসস্টপ, রেলওয়ে স্টেশনসহ জনপরিসরে (পাবলিক প্লেসে) ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
রিটে বলা হয়েছে, এমন পরিবেশে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করতে হবে যেখানে কোন মা সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে কোনো অস্বস্তি বোধ করবে না বা যৌন হয়রানির শিকার হবে না। সেটা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
জনস্বার্থে করা এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ২৭ অক্টোবর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খোন্দকার মো. দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন।
রুলে দেশের সব শপিংমল, কর্মক্ষেত্র, এয়ারপোর্ট, বাসস্টপ, রেলওয়ে স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
একই সঙ্গে জনপরিসরে (পাবলিক প্লেসে) ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনে নীতিমালা তৈরি করতে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল।
মন্ত্রী পরিষদ সচিব, নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, সমাজকল্যাণ সচিব, বিমান ও পর্যটন সচিবসহ ১৭ জন বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।
পরবর্তীতে বিগত ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারক) ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ সারা দেশের কলকারখানা ও মিলগুলোতে ২ মাসের মধ্যে ব্রেস্টফিডিং রুম স্থাপনের নির্দেশ দেয়।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে নয় মাস বয়সী কোনো শিশু এই প্রথম পিটিশনার হয়েছে। ছোট্ট শিশুর রিট পিটিশনার হতে আদালতের অনুমতিও নিতে হয়েছে। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে প্রায় সাড়ে ৩ বছর পর রিটের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন।
এই রিটের ফলশ্রুতিতে দেশের সবগুলো বিমান বন্দর, রেল স্টেশনসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে ব্রেস্টফিডিং রুম স্থাপিত হয়েছে বলে আদালতে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রায়ের পর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, মা ও শিশুদের অধিকার রক্ষায় মহামান্য হাইকোর্ট এ রিট পিটিশন দাখিলের প্রেক্ষিতে রুল, নির্দেশনাসমূহ এবং চূড়ান্ত শুনানির পরে আজকে মহামান্য হাইকোর্ট এই যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করলেন।
তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদে স্বীকৃত অন্যতম মৌলিক অধিকার জীবনের অধিকার বিষয়ে এই রায় নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রায়। একাধিক ব্রেস্টফিডিং রুম ইতোমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে। এই যুগান্তকারী রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে কর্মজীবী নারীরা শিশুদের কর্মক্ষেত্রে রেখেই স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবেন।
আমি মনে করি, কর্মস্থল, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, শপিংমল সহ সকল জনবহুল স্থানে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর নিরাপদ পরিবেশ সম্বলিত ব্রেস্ট ফিডিং রুম ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপন সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের জন্য একটা উদাহরণ সৃষ্টি করবে যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য অনুসরণীয় হবে বলেও জানান রিটকারী আইনজীবী।
প্রসঙ্গত, উমাইর মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল কক্সবাজারে। সমুদ্র সৈকতে বেড়ানো শেষে ঢাকায় ফেরার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়। সেখানে অনিবার্য কারণে ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টার বিলম্ব হয়। কিন্তু সেখানেই বিপদে পড়ে সে। প্রচুর ক্ষুধায় কান্না জুড়ে দেয়। শিশুটির কান্না থামাতে মা বুকের দুধ খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার মা এই শিশুটিকে দুধ খাওয়ানোর কোনো পরিবেশই পাচ্ছিলেন না। পরে ঢাকায় এসে, শিশু উমাইরকে নিয়ে তার মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান হাইকোর্টে এই রিট দায়ের করেন।