বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারো অনুকম্পায় নয়। স্বাধীনতার সময় যারা বিরোধিতা করেছিল, তারাই এখন বিরোধিতা করছে। তাই এই ভিসা নীতিতে আমরা বিচলিত নই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো আমেরিকা যাইনি। ভবিষ্যতেও কখনো যাব না।
আজ সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টে শেষ কর্মদিবস পালন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিচার বিভাগের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে গেছি। কখনো নিজের কিংবা পরিবারের কথা ভাবিনি। মামলার জট নিরসনে সারাদেশের বিচারকদের উৎসাহিত করেছি ও নির্দেশনা দিয়েছি। বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার জন্য সারাদেশের আদালত অঙ্গনে ন্যায়কুঞ্জ স্থাপন করেছি। মেডিয়েশনের মাধ্যমে মামলাজট কমাতে সুপ্রিম কোর্টে মেডিয়েশন সেন্টার স্থাপন করেছি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি একজন ডায়নামিক ব্যক্তিত্ব। আশা করি তিনি বিচার বিভাগকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করবেন।
এ সময় নব নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. বোরহান উদ্দিন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম প্রধান বিচারপতিকে বিদায় জানান।
এর আগে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে প্রধান বিচারপতির খাস কামরায় যান। এরপরই তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। বিদায় জানান সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অবসরে গেছেন আজ। এর মধ্য দিয়ে ১৭ বছরের বিচারক জীবনের ইতি ঘটেছে তাঁর।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি পদে শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি টানা ২০ মাস বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর জীবন ও কর্মকালের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপ।
জন্ম, পরিচয় ও পড়াশোনা
আবদুল গোফুর মোল্লা ও নূরজাহান বেগম দম্পতির সন্তান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার রমানাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
তিনি খোকসা জানিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে সরকারি পি.সি. কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরে তিনি ধানমন্ডি ল’ কলেজ থেকে আইনে স্নাতক পাস করেন।
কর্মজীবন
১৯৮১ সালে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। একই বছরের ২১ আগস্ট জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি আইনজীবী হিসেবে হাইকোর্ট এবং ১৯৯৯ সালের ২৭ মে আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হন।
তিনি খুলনা সিটি কর্পোরেশন, কুষ্টিয়া পৌরসভা, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন সংস্থা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রধান আইন উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি তার দায়িত্ব পালনে অসুবিধার কথা উল্লেখ করে ৪ জুন ২০০৮ সালে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
বিচারিক জীবন
২০০১ সালে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তবে হাইকোর্টের নিয়মিত বিচারপতি থাকা সত্ত্বেও ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়।
বাধাকে জীবনের অংশ মেনে নিয়ে সততার সাথে জীবন পরিচালিত করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ উদাহরণ, নিজের জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের নানা গল্প অকপটে স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত বা অস্বস্তিবোধ করেন না।
সকল উত্থান-পতনে ধৈর্য ধরে নিমগ্ন সাধনারত হয়ে করতে হবে অপেক্ষা, হতে হবে সৎ ও পরোপকারী, এমন সব মৌলিক নৈতিকতা জীবনের অংশ বানিয়ে নেওয়া এই বিচারকের জীবনেও অপমানজনক ভাবে কালো অধ্যায় তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে বিচারক জীবনে পুনর্বহাল হয়েছেন সসম্মানে।
কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন কিছু মানুষ মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে কিন্তু মনোবল হারালে চলবে না। তাঁর এই অগাধ বিশ্বাস আর কর্মময় জীবনের নৈয়মিক অনুশীলন তাঁকে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে সমাসীন করেছে।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ আপিল বিভাগের বিচারক হন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, তিনি প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারপতি হিসেবে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। এছাড়াও তিনি সৌদি আরব সফর করেছেন।
এছাড়াও তিনি ৩০ এপ্রিল ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমবার মেয়াদ শেষ হলে তাকে ৪ মে ২০২০ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে পুনরায় নিযুক্ত করা হয়।
২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
তাঁর বড় ভাই বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি থেকে অবসরে গিয়েছেন। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দেশের ইতিহাসে প্রথম দুই ভাই যারা সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে আসীনের নজির স্থাপন করেছেন।
সাফল্য
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কর্মকাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালনই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিচার বিভাগে গতিশীলতা আনতে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সমন্বয়ে বেঞ্চ পুনর্গঠন, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ বেঞ্চ গঠনসহ বিচারকদের পূর্ণ কর্মঘণ্টা কাজে ব্যয় করার নির্দেশনা দিয়ে বেশ কিছু আদেশ জারি করেন।
অধস্তন আদালতে বিভাগওয়ারি মামলাজট তদারকি ও পর্যালোচনাসহ মামলা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে হাইকোর্টের আট বিচারপতির নেতৃত্বে পৃথক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। বছরব্যাপী এসব কমিটি নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে।
প্রধান বিচারপতি দেশের অধস্তন আদালতগুলো পরিদর্শন করার পাশাপাশি সেখানকার সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন; বিচারক ও আইনজীবীদের মামলাজট কমাতে তাগিদ দেন। এসব তৎপরতা সার্বিকভাবে মামলাজট কমাতে সহায়ক হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের সব আদালতে বিচারাধীন ছিল ৪২ লাখ ৮ হাজার ৯৮৭টি মামলা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ছিল ৪২ লাখ ৩ হাজার ৫১৬টি। এ সময়ে নতুন মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি বেড়েছে।
এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কর্মকালে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্মারকসংবলিত স্তম্ভ ‘স্মৃতি চিরঞ্জীব’। এখানে আরও রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৬৯ আইনজীবীর নামের তালিকা।
সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ন্যায়কুঞ্জ’ নামে বিশ্রামাগার।