ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য: স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনো বাংলাদেশে Land Ownership Dispute বা জমি মালিকানা বিরোধ চলে আসছে। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে জমি নিয়ে বিরোধ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে বাংলাদেশে তার বিপরীত।
আমরা শৈশব থেকে পাঠ্যপুস্তকে দেখে এসেছি “জোর যার মুল্লুক তার” এবং আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই নীতিকে তারা সাপোর্ট করে আসছে যেমন Adverse Possession যার মাধ্যমে জমির প্রকৃত মালিক (বাদী) যদি ১২ বছরে তার সম্পত্তি দখল নিয়ে কোন আইনি প্রক্রিয়ায় না যায় তাহলে দখলকৃত (বিবাদী) ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জিত হবে এবং অনুরূপভাবে ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারায় সম্পত্তির অধিকার বিলুপ্তির ব্যাপারে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি পাশ হওয়া ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ এ ভূমি সংক্রান্ত অনেক জটিলতা সমাধান করবে, তবে শর্ত থাকে যে, এই আইনের বিধানাবলি অন্যান্য আইনের কোনো বিধানের ব্যত্যয় না হয়ে এর অতিরিক্ত হবে। বর্তমানে প্রচলিত জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আইনের যে শূন্যতা ছিল তা অনেকাংশে নতুন ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন দ্বারা পূর্ণ হবে।
এই আইনের ৪ ধারায় ভূমি হস্তান্তর, জরিপ, রেকর্ড হালনাগাদ করণ বা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কখন প্রতারণা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। যেমন কোন ব্যক্তি তথ্য গোপন করে কোন ভূমি সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ অন্য কোন ব্যক্তি বরাবর হস্তান্তর বা সমর্পণ করলে আগে যেখানে দলিল বাতিলের মামলা করতে হত এখন নতুন আইন অনুযায়ী থানাতে মামলা দায়ের করতে পারবেন, যদি থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানাই তাহলে কোর্টে সরাসরি আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং পুলিশ চাইলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবেন আদালতের অনুমতি ছাড়া। আগে যেখানে জমি সংক্রান্ত মামলায় Ad valorem Court fee দেওয়া লাগতো তা এখন ফৌজদারী মামলা রূপে মিনিমাম Court Fee দিয়ে মামলা দায়ের করা যাবে।
এই আইনের বিশেষত্ব হলো এই আইনে মামলা করলে তা Cognizable offence (আমল যোগ্য অপরাধ) এবং Non bailable (জামিন অযোগ্য), Non Compoundable (আপোষ অযোগ্য)।
আমার আইনগত পেশা জীবনে অনেক মামলায় দেখেছি ভুয়া ওয়ারিশ সার্টিফিকেট নিয়ে এক ভাইয়ের সম্পত্তি আরেক ভাই বিক্রি করে দিয়েছেন বা এক ভাই তার অংশের চেয়ে বেশি অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন এখন নতুন আইনের ৪(১)গ ধারা অনুযায়ী সরাসরি ফৌজদারী মামলা করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে উক্ত আইনের ৪(২) অনুযায়ী সর্বোচ্চ (৭) সাত বছর কারাদন্ড ও অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৪(১) ধারায় আরো বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি মিথ্যা বিবরণ সংবলিত কোন দলিলের স্বাক্ষর বা সম্পাদন করলে এমনকি কর্তৃপক্ষকে যেমন AC Land বা Sub Registrar অফিসে মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে একই দন্ডে দণ্ডিত হবেন।
বর্তমান সময়ে এটা প্রায়ই দেখা যায় ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে সাদা/ অলিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে বেআইনি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় এক্ষেত্রে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ এর ৫(১) এ ভূমি জালিয়াতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি দলিলের কোন অংশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিবর্তন করে সংক্ষেপে বলতে গেলে যে উদ্দেশ্যে দলিলটি করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্যে ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে দলিলটি ব্যবহার করা হলে তা উক্ত আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর এবং অর্থদণ্ড।
উল্লেখ্য যে, এ আইনের অধীন দায়েরকৃত মামলায় কোনো দলিল প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত বা প্রস্তুতকৃত মর্মে প্রমাণিত হইলে, সংশ্লিষ্ট আদালত উক্ত মামলার রায় বা আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করিয়া উহা প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত বা প্রস্তুতকৃত মর্মে সংশ্লিষ্ট নথি, রেজিস্টার বা রেকর্ডপত্রে লিপিবদ্ধ করিবার আদেশ প্রদান করিবেন। তার জন্য আলাদা কোন দেওয়ানী মামলা করার প্রয়োজন নেই। এতে করে একদিকে যেমন বিচার প্রার্থীদের সময় এবং খরচ কমবে অন্যদিকে আদালতে মামলা যট কমবে।
এই আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো যদি কর্তৃপক্ষকে যেমন AC Land বা Sub Registrar অফিসে কোন ব্যক্তি দলিল উপস্থাপন করে এবং উক্ত অফিস যদি উপস্থাপনকৃত দলিলটি জাল বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উক্ত বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে তা বিচারার্থ উপযুক্ত ফৌজদারি আদালতে প্রেরণ করবে।
উক্ত আইনের ৬(৩) ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তির নামে ভূমির State Acquisition and Tenancy Act, 1950 (Act No. XXVIII of 1951) এর section 143 বা 144 এর অধীন প্রণীত বা হালনাগাদকৃত বলবৎ সর্বশেষ খতিয়ান না থাকিলে এবং অনুরূপ খতিয়ান ও হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমাণক প্রদর্শনে ব্যর্থ হইলে, তিনি উক্ত ভূমি বিক্রয়, দান, হেবা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন বা দলিল রেজিস্ট্রেশন করিতে পারিবেন না, তাই জমি হস্তান্তর বা বিক্রয় এর ক্ষেত্রে অবশ্যই হালনাগাদকৃত সর্বশেষ খতিয়ান থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে অনেক মামলায় দেখেছি অনেক বিক্রেতা জমি বিক্রি করার পরে উপযুক্ত কারণ ছাড়া ভূমির দখল স্থানান্তর করেন না, এক্ষেত্রে এই আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে এটি একটি অপরাধ এবং তার জন্য সর্বোচ্চ (২) দুই বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া যাবে।
অনেক সময় দেখা যায় জমির সীমানা নিয়ে প্রায় দুই পক্ষের মধ্যে ঝামেলা থাকে এবং সীমানায় অবস্থিত স্থাপনা বৃক্ষ বা ফসলের ক্ষতি সাধন করে। নতুন আইন অনুযায়ী তা একটি অপরাধ এবং এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ (২) দুই বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া যাবে।
উপরোক্ত আলোচনায় বলা যায়, নতুন আইন প্রয়োগের ফলে ভূমি সংক্রান্ত প্রতারণা এবং জালিয়াতি অনেকাংশই হ্রাস পাবে দলিলের প্রকৃত মালিকের দাবির প্রতিকার সহজ হবে। যদি কেউ প্রতারণা বা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমি দাবি করে তাহলে এক্ষেত্রে একটি মামলায় নিষ্পত্তি এবং প্রতারক এর বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে যা পূর্বে ছিল না এবং পৃথক মামলা করতে হতো।
দলিল যার জমি তার তখনই যখন এই আইনের ব্যবহার এবং প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে পারবে। নতুন এই আইন নিঃসন্দেহে ভূমি সংক্রান্ত মামলা জটিলতা অনেকাংশে কমিয়ে তার প্রতিকার সহজ করে দিয়েছে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।