সাব্বির এ মুকীম: আসামী তথা মূল মামলার অভিযুক্ত এর দায়েরকৃত ২০২২ সনের ৪২৩৯৩নং ফৌজদারি বিবিধ মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি ফরিদ আহমেদ কর্তৃক প্রদত্ত বিগত ১১/০৬/২০২৩ ইং তারিখে প্রদত্ত রায়ে চেক এর মামলা দায়েরের সময় আরজীর সাথে বাদী এফিডেভিট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রায় এর সাথে উক্ত বেঞ্চ এর অপর বিচারক বিচারপতি আতোয়ার রহমান সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন।
আলোচ্য রায়ের মূল মামলা ছিলো চেক এর মামলা। বর্তমানে বাংলাদেশে এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারায় তথা লোকপ্রিয় বচনে চেক এর মামলা বা নালিশ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। দেশের যুগ্মজেলা জজ আদালতগুলো চেক এর মামলায় মামলায় নুব্জ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রায়। কেবল নিম্ন আদালতই নয়, মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট ও চেক এর মামলা হতে উদ্ভূত কোয়াশমেন্ট এর দরখাস্তের বিপুল সংখ্যা লয়ে তটস্ত। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রায়ের ২১তম পৃষ্ঠার নির্দেশনা এবং ১৩তম পৃষ্ঠার ৩য় অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পড়লে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, উক্ত দুরাবস্থা হতে উত্তোরণের আশায় বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন চেক এর মামলা দায়েরে এফিডেভিট বাধ্যতামূলক করেছেন। মূলত আমলী আদালতকে নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে এফিডেভিট বাধ্যতামূলক আদেশ হয়।
এই রায়ের ১৩তম পৃষ্ঠার ৩য় অনুচ্ছেদের ৩য় লাইন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যাতে বিজ্ঞ আদালত বলেন- “The cognizance court can take another measure, that is, all complaint of section 138 cases, complainant must file an affidavit of facts regarding the impugned cheque had been drawn by the accused himself not by the complainant”।
অর্থ্যাৎ চেক মামলা দায়ের কালে নালিশী দরখাস্তের পাশাপাশি মজহর বা নালিশকারী – এই মর্মে এফিডেভিট মূলে ঘোষণা করবে যে মজহর নিজে নন বরং নালিশী চেকটি অভিযুক্ত ব্যক্তি পূরণ করে তাকে প্রদান করেছেন । বিজ্ঞ আদালত রায়ের ২১তম পৃষ্ঠায় লেখেন
“The directions are as follows
(1) We direct the cognizance court to receive an affidavit of facts specify that the drawer has filled up all spaces of the cheque and signed with the petition of complaint under section 138 of Negotiable Instrument Act, 1881.
(2) The cognizance [court] must be satisfied on the contention of complaint petition”
অর্থ্যাৎ বিজ্ঞ আমলী বিচারিক হাকিম এর নিকট চেক এর মামলা দায়ের করতে হলে নালিশী সম্পূর্ণ চেক এবং এর প্রয়োজনীয় সকল অংশ অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক পূরণকৃত মর্মে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে মজহরকে এফিডেভিট দিতে হবে।
যে কারণে এফিডেভিট বাধ্যতামূলক করলেন বিজ্ঞ আদালত
এই রায়ের ১৩ পৃষ্ঠায় ২য় অনুচ্ছেদে বিজ্ঞ আদালত খেদের সাথে লেখেন যে, চেক এর মামলায় নিম্ন আদালতগুলো ব্যাংকগুলোর রাবার স্ট্যাম্প এ পরিণত হয়েছে। ঋণ প্রক্রিয়ায় ইচ্ছেমতো খালি চেক নিয়ে পরে সেসব চেক ব্যবহার করে মামলার পাহাড় গড়ে তোলা হচ্ছে। রায়ের ২১ পৃষ্ঠায় বিজ্ঞ আদালত আরও লেখেন যে সেসমস্ত মামলাগুলো উচ্চ আদালতকেও ভারী করে তুলছে।
এই এফিডেভিট বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এফিডেভিট এর বাধ্যবাধকতার দোহাই টানেন। চেক এর মামলার অভিযুক্তরা উচ্চ আদালতে ভিড় করছে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই যুক্তিতে যে চেক এর লেখা অভিযুক্তর নয়। সামগ্রীক প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য রায় প্রদান করেন।
বিচারের ইস্যু সমূহ
রায়ের স্পষ্ট করে লেখা না থাকলেও রায়ের সামগ্রীক পাঠ এ, নিচের ইস্যুগুলো কেন্দ্র করে রায় দেয়া হয়েছে মর্মে অনুভূত হয়।
(১) চেক এর মামলায়আসামী পক্ষের জবানবন্দী ও মজহর কে জেরার সাজেশন কে প্রামাণ্য হিসেব নেয়া যাবে কিনা?
উত্তর: হ্যাঁ। রায়ের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠার ৩য় অনুচ্ছেদ এ তেমনটাই বলা আছে।
(২) নালিশী চেক এর গ্রহীতার নাম, তারিখ, টাকার পরিমান ইত্যাদি কার দ্বারা লেখা হতে হবে?
উত্তর: চেক এর মামলায় নালিশী চেক এর গ্রহীতার নাম, তারিখ, টাকার পরিমান ইত্যাদি চেক দাতা তথা অভিযুক্ত ব্যাক্তি কতৃক লিখিত হতে হবে। মজহর এর লেখা গ্রহনযোগ্য নয়। রায়ের ৮ম পৃষ্ঠার ১ম অনুচ্ছেদ শেষ বাক্যের আগের বাক্যে তেমনটাই বলা আছে।
(৩) বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য মামলায় নালিশী চেক এর গ্রহীতার নাম, তারিখ, টাকার পরিমান ইত্যাদি কে লিখেছিলো?
উত্তর: চেক এর মামলায় নালিশী চেক এর গ্রহীতার নাম, তারিখ, টাকার পরিমান ইত্যাদি মজহর এর লেখা। চেক দাতা তথা অভিযুক্ত ব্যাক্তি কতৃক চেকটি লিখিত হয় নাই। রায়ের ৮ম পৃষ্ঠার ১ম অনুচ্ছেদ এ তেমনটাই বলা আছে।
(৪) নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এক্ট এর ৫ ধারা ও ৬ ধারার আলোকে চেক এর মামলা করতে চেক এর কোন কোন উপাদান প্রয়োজন?
উত্তরঃ ভারতের গোড়ম বনাম অন্ধ্র ব্যাংক এআইআর ২০০ এপি ৩৭৯ মামলা হতে ধার করে বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য রায়ের ১১তম পৃষ্ঠায় চেক মোট ৭টি উপাদান চেক এর মামলা করতে আবশ্যক বলা হয়েছে, যথা
- চেকটি লিখিত হবে,
- চেকদাতার নিঃশর্ত আদেশ সম্বলিত হতে হবে,
- সুনিদৃষ্ট ব্যাংকার এর প্রতি সে আদেশ প্রযোজ্য হবে, যেনো ব্যাংকার নীচের ব্যাক্তিদের চেক এর অংকের অর্থ প্রদান করেন, তথা-
ক. কোনো নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে, অথবা
খ. কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির আদেশ মোতাবেক, অথবা
গ. চেকবাহক কে
- চেক এর বিপরীতে অন্য কোনো উপায়ে নয় কেবল চাওয়া মাত্র অর্থ প্রদানযোগ্য হতে হবে,
- টাকার পরিমান সুনিদৃষ্ট হতে হবে,
- চেক এ টাকার পরিমান সুস্পষ্টভাবে লেখা থাকতে হবে,
- চেক দাতা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এরে গ্রাহক হতে হবে
(৫) বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য বিরোধে কোনো কনসিডারেশন ছিলো কীনা?
উত্তরঃ না, কনসিডারেশন ছিলো না। রায়ের ১২ম পৃষ্ঠার ১ম বাক্যের শেষে তেমনটাই বলা আছে।
(৬) বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য মামলায় আদৌ চেকটি অভিযুক্ত কতৃক প্রদত্ত কীনা ?
উত্তরঃ না। আইন মোতাবেক – অভিযুক্ত কতৃক চেক দেয়া হয়েছে বলা অসম্ভব। রায়ের ১২তম পৃষ্ঠার ৩য় বাক্যে এবং ২০তম পৃষ্ঠার ২য় অনুচ্ছেদে তেমনটাই বলা আছে।
(৭) ম্যাসেঞ্জারে বা ইনস্টাগ্রামে পক্ষগণের মধ্যকার করা চ্যাট আদালতে প্রমান হিসেবে দাখিলযোগ্য কীনা?
উত্তরঃ হ্যাঁ, ম্যাসেঞ্জারে বা ইনস্টাগ্রামে পক্ষগণের মধ্যকার করা চ্যাট আদালতে প্রমান হিসেবে দাখিলযোগ্য। রায়ের ১৪তম পৃষ্ঠার ৩য় অনুচ্ছেদ এ তেমনটাই বলা আছে।
(৮) বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য মামলায় রায়ের পূর্বে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এই চেক এর মামলায় ফৌজদারী কার্জবিধির ৫৬১(এ) বিধি মোতাবেক অভিযুক্ত পক্ষে মামলা বাতিলে দরখাস্ত চলে কীনা?
উত্তরঃ ন্যায় বিচারের স্বার্থে বক্ষ্যমান লেখায় আলোচ্য মামলায় ফৌজদারী কার্জবিধির ৫৬১(এ) বিধি মোতাবেক অভিযুক্ত পক্ষে মামলা বাতিলে দরখাস্ত চলে। কারণ প্রমাণে সুস্পষ্ট যে চেকটি নিয়ে কারসাজি করা হয়েছে। যদি অভিযুক্ত ব্যাক্তি কে আপিলে যেতে হয় তাহলে তাকে চেক এর ৫০% তথা ৯০ লক্ষ টাকা দাখিল করতে হবে, যা অভিযুক্তর জন্য অবিচার হবে। রায়ের ১২ম পৃষ্ঠার ৫ম বাক্যে তেমনটাই বলা আছে।
মামলার ফলাফল
বিস্তারিত আলাপ শেষে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন মামলাটি ফৌজদারী কার্জবিধির ৫৬১(এ) বিধি মোতাবেক মামলা বাতিল তথা কোয়াশ করেন। তবে আলোচ্য রায় পাঠে সবচে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো চ্যাট করার সময় গালিগালাজ করলে তা গোপন থাকে না। সম্ভবনা থাকে যে সেসব গালিগালাজও রায়ে প্রমাণ হিসেব গণ্য হতে পারে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, কুমিল্লা জজ কোর্ট। ই-মেইল: samukim1@gmail.com