বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন ৬ জন বিচারপতির বেঞ্চ শুনতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য করেছেন দেশের শীর্ষ আদালত। আগামী বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) এ বিষয়ে আদেশ দেবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আজ বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির বেঞ্চ এই আদেশের জন্য এ দিন ধার্য করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি বোরহানউদ্দিন, বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গির হোসেন।
এর আগে রিটকারীর আইনজীবীর সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে শীর্ষ আদালতের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ শুনানির জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন।
২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়।
আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি দেখিয়ে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন।
ওই বছরের ৮ মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে ১১ দিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আপিল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন।
অপর নয় অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।
২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেন।
ওই বছরের ১১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরো বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
আদালত রায়ে আরো বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সাংসদরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সংসদ সদস্যদের সবসময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে সাংসদদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
রায়ে আরো বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।
সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন।