দুর্নীতির দায়ে সেটেলমেন্ট অফিসার ও সার্ভেয়ারের কারাদণ্ড
মহানগর দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।

তিন পুলিশ নির্দোষ মর্মে প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ

হেফাজতে নির্যাতনের মামলা

স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজিব কর রাজুকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে রাজধানীর কোতয়ালী থানার তিন পুলিশ সদস্য নির্দোষ মর্মে দাখিল হওয়া প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদীর নারাজির ওপর জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন আদালত।

আজ সোমবার (২৭ নভেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান দীর্ঘ আট মাস পর বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

বাদী গত মার্চ মাসে এ নারাজি দাখিল করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বাদির জবানবন্দি গ্রহণ পিছিয়ে যায়।

সোমবার বাদীর আইনজীবী সুমন কুমার রায় আদালতকে বলেন, দীর্ঘদিন বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের জন্য মামলাটি রয়েছে। কিন্তু তা গ্রহণ করা হচ্ছে না। হয় জবানবন্দি গ্রহণ করুন, না হয় নারাজি আবেদন খারিজ করে দিন। এরপর আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

জবানবন্দিতে বাদী আদালতকে বলেন, ‘এ সংক্রান্তে পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে আসামিরা দোষী প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনফেস্টিগেশন (পিবিআই) আসামিদের বিরদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়া হস্যকর। তদন্তকালীন তারা আমার সঙ্গে টাকা পাওয়ার বিনিময়ে আপস করতে চেয়েছিল আমি রাজি হই নাই। সঠিক তদন্ত হয় নাই। আমি বিচার চাই।’

বাদীর জবানবন্দির পর আদালত পরে আদেশ দেবেন বলে জানান।

২০১৩ সালের ২ মার্চ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) এর ৪/৫ ধারায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজিব কর রাজু ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় রাজধানীর কোতয়ালী থানার এসআই মিজানুর রহমান, এসআই জলিল ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়াকে আসামি করা হয়।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক (বর্তমানে বিচারপতি) কেএম ইমরুল কায়েশ বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনফেস্টিগেশন (পিবিআই)কে তদন্তের নির্দেশ দেন।

মামলায় অভিযোগ, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া সাদা পোশাকে ভিকটিমের ৬৯ নম্বর গোয়ালনগর কোতয়ালীর বাসায় সিলিং ভেঙে ঢুকে। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসামিরা ভিকটিম রাজুকে হাতকড়া পরিয়ে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে।
ভিকটিমের বাসা তল্লাশি করে ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৮ টাকার স্বর্ণ এবং তার মায়ের চোখ অপারেশন করার ৪১ হাজার ৩০০ টাকা ছাড়াও বাসা থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ কোতয়ালী থানায় নিয়ে যায়।

সেখানে নিয়ে আসামিরা তার ওপর অমানসিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে ভিকটিম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে তাকে আবার থানায় নিয়ে আসে আসামিরা। তাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বলে পুলিশ। টাকা না দিলে অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি বানিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিকে আবারও নির্যাতন করে পুলিশ কর্মকর্তারা।

নির্যাতনে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজুকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থানায় এনে দ্বিতীয় দফায় নির্যাতন করে এসআই জলিল। হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়। বাম হাত ভেঙে দেওয়া হয়। বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে অচল করে ফেলা হয়। এরপর ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে, না দিলে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়।

খবর পেয়ে রাজুর বড় ভাই আশিষ কর এসআই মিজানের হাতে ২ লাখ টাকা তুলে দেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে সাদা কাগজে নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লিখে রাখেন। এরপর পুলিশ হুমকি দিয়ে বলে, তুই যদি মুখ খুলিস এবং তোকে যদি তাঁতীবাজার এলাকায় দেখতে পাই তবে মেরে ফেলব।

আসামিদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে ভিকটিম প্রায় এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে এ বিষয়ে ভিকটিম কোতয়ালী থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিয়ে তাকে ঘুরাতে থাকেন। শেষে আদালতে মামলা করেন।

অন্যদিকে বাদী এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করলে অভিযোগটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ হেডকোয়াটার্সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রদান করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশ আসামি মিজানুর রহমান, মো. আব্দুল জলিল এবং ফরিদ মিয়াকে একটি ইনক্রিমেন্ট সমপরিমাণ অর্থ আগামী ৫ বছরের জন্য কর্তনের আদেশ প্রদান করেন।

আর আদালতে করা মামলায় পিবিআই ঢাকা মেট্টো (উত্তর) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিয়া কুতুবুর রহমান চৌধুরী অভিযোগ প্রমানিত হয়নি মর্মে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেন।

পুলিশ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর বাদী গত ২ মার্চ আদালতে নারাজি দাখিল করেন। নারাজি দাখিলের দিন বাদী জবানবন্দি গ্রহণের বিধান থাকলেও সেদিনসহ জবানবন্দি গ্রহণের জন্য চারটি ধার্য্য তারিখ গেলেও আদালত জবানবন্দি গ্রহণ করেন নাই।

এ সম্পর্কে বাদীর অভিযোগ পিবিআই সম্পূর্ণরূপে আসামিদের পক্ষ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এখানে তদন্ত কর্মকর্তা শ্রী কৃষ্ণ মন্ডল নামে এক ব্যক্তি আমাকে স্বর্ণ কেনার জন্য টাকা দেয়। তার অভিযোগের ভিত্তিতে আমার বাসায় আসামিরা আসে বলেছেন। যে ব্যক্তিকে আমি চিনি না, দেখিনিও। সে ব্যক্তির সঙ্গে আমার একটি আপসনামা দেখানো হয়েছে। যা জাল-জালিয়াতির মধ্যেমে সৃজন করেছেন। মামলা তদন্তাধীন অবস্থায় একাধিক জায়গা থেকে টাকা নিয়ে আপসের প্রস্তাব করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই বলেছেন, ‘২৫ লাখ টাকা নিয়ে দেই, আপস করে ফেলেন। আমি রাজি হইনি। আমি বিচার চেয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি নারাজি দিয়েছি।’