দীপজয় বড়ুয়া: এজাহারে অনেক সময় আসামির নাম উল্লেখ না করে অভিযোগকারী বা ভিকটিম আসামিকে দেখলে চিনবেন এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন ।তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা এই আসামি সনাক্তকরণ মহড়ার জন্য আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেন। ১৯৪৩ সালে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল অর্থাৎ PRB এর ২৮২ এর প্রবিধান মতে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্তকরনের জন্য শনাক্তকরণ মহড়া বা Test Identification Parade (TI Parade) প্রবর্তন করা হয়।
P.R.B-282 অনুযায়ী TI Parade বলতে বুঝায় যে, “কোন সন্দেহভাজন আটককৃত অপরাধের সাথে জড়িত অভিযুক্ত আসামিকে জেলখানার ভিতরে বাদী এবং সাক্ষী কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে নির্ধারিত দিন ও তারিখে সনাক্তকরণের জন্য যে মহড়া অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয় তাহাকেই টি আই প্যারেড বা টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড বা সনাক্তকরণ মহড়া বলে।”
এটি একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণিকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়া কেবলই পুলিশ বা অন্য কোন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ তাদের তদন্ত কার্যে ব্যবহার করে থাকে। তখন ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জেলহাজতে রাখার আদেশ প্রদান পূর্বক সনাক্তকরণ মহড়ার তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করে আদেশ দেন।
নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী, ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে হাজির করার এবং সেই সাথে যারা সন্দেহজনক ভাবে অভিযুক্ত (একাধিক ব্যক্তি) তাদের হাজির করার নির্দেশ দেন আদালত। তখন ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জেলহাজতে রাখার আদেশ প্রদান পূর্বক সনাক্তকরণ মহড়ার তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করে আদেশ দেন। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এখানে সাক্ষী, ভিকটিম বা অভিযোগকারী যেন টিআই প্যারেড এরপূর্বে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কে কোনক্রমে দেখার সুযোগ না পায়। শুধুমাত্র এই টি আই প্যারেড চলাকালীন সময়ে তাদেরকে দেখবেন। তারপর সাক্ষী বা ভিকটিম বা অভিযোগকারী শনাক্ত করবেন আসল অপরাধী কে? এই মহড়াকে টি আই প্যারেড বলে ।
সনাক্তকরণ মহড়ার উদ্দেশ্যে
সনাক্তকরণ মহড়া দ্বারা মূল সাক্ষ্য সৃষ্টি হয় না। এর উদ্দেশ্য দুইটি। প্রথমত, কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত হওয়া যে অপরাধের সংগে জড়িত ব্যক্তির সাক্ষীর জানা নাই এবং দ্বিতীয়ত, তদন্তকারী যে সাক্ষ্য পাইয়াছে তাহার প্রতি সমর্থন আদায় করা।
সাক্ষ্য আইনের ৯ ধারায় সাক্ষীর অপরিচিত ব্যক্তিকে সনাক্ত করার জন্য সনাক্তকরণ মহড়ার কথা বলা হয়েছে। সনাক্ত মৌখিক উক্তি দ্বারা, হাত দ্বারা স্পর্শ করে, আংগুলি নির্দেশনা দ্বারাও হতে পারে। যেভাবেই সনাক্ত হোক না কেন তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় বিবৃতির সমতুল্য। ব্যক্তি বা বস্তু উভয়ই সনাক্ত হতে পারে।
42 DLR (AD) 189, 191 Abdul Hasem @ Bacchu Fakir & others vs State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “Observation of Justice M Mahmudur Rahman “Mere placing no reliance upon confessional statement of the accused and non examination of the Magistrate who held TI parade are no ground for acquittal where the order of conviction and sentence is based on other sufficient and reliable legal evidence on record.”
উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলায় সনাক্তকরণ মহড়া সম্পর্কে কতিয়পয় সিদ্ধান্ত নিম্নে উল্লেখ করা হল
5 BLD(1985)15 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ সনাক্তি মিছিলে ঐ সাক্ষীর জন্য ঐ সাক্ষীর জন্য ঐ সাক্ষীর প্রতি কতটা সতর্কতা অবলম্বন করা হইয়াছিল তাহার উপর সনাক্তি সাক্ষীর গুরুত্ব নির্ভর করে”।
39 DLR 27 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ বিলম্বিত সনাক্ত মিছিল সনাক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করিয়া দেয়”।
19 DLR 662 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সনাক্তির সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য করবার জন্য ৩টি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবেঃ-
প্রথমত- আসামীর নাম সনাক্তকারীর অজানা ও অপরিচিত হতে হবে।
দ্বিতীয়ত– অপরাধ সংঘটনের পরে আসামীকে দেখিবার কোন সুযোগ আসামীকে দেওয়া যাবে না।
তৃতীয়ত– সনাক্ত নির্ভুল হতে হবে”।
AIR 1988(SC)345 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ যথাযথ সনাক্ত হইয়াছে কিনা তা নির্ভর করে কতটা দ্রুততার সংগে তাহা অনুষ্ঠিত হয় তার উপর”।
49 DLR 83 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “আসামীর সনাক্ত মিছিল বিচারিক কার্যক্রম নহে। তদহেতু সনাক্তমিছিল পরিচালনাকারী ম্যাজিষ্ট্রেটের সাক্ষ্য ব্যতীত তাহার লিখিত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নহে”।
সনাক্তকরণ মহড়া বা TI Parade কিভাবে পরিচালনা করা হয়
ম্যাজিস্ট্রেট নিরপেক্ষ সাক্ষী ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে নিয়ে কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করবেন এবং সাক্ষী ভিকটিম বা নিরপেক্ষ সাক্ষীকে আসামি শনাক্তকরণের জন্য কয়েক মিনিট সময় দিবেন , তারপর নির্দিষ্ট ফরমে তা লিপিবদ্ধ করবেন এবং সাক্ষী বা ভিকটিম যাই হোক তার স্বাক্ষর গ্রহন করবেন । অতঃপর ম্যাজিস্ট্রেট নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করবেন এবং নিজে সার্টিফিকেট লিখে দস্তখত করবেন ।
সনাক্তকরণ মহড়ার পদ্ধতি
১। কোন অপরাধ সংঘটনের দায়ে কখনও কোন অভিযুক্ত আসামীকে সনাক্ত করার প্রয়োজন হলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা মামলায় আগ্রহী নয় এই রকম দুইজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ পরিবেশে সনাক্তকরণ করতে হবে।
২। সন্দেহজনক ব্যক্তি একজন হলে ৮ বা ১০ জন এবং একাধিক হলে ২০ থেকে ৩০ জন একই পোশাক পরিহিত, একই সামাজিক মর্যাদা ও ধর্মের অনুসারী লোকের সাথে হাঁটাতে হবে। এ মিশ্রণ পুলিশ বা সাক্ষীদের সামনে হবেনা।{AIR 1961(all): 1961 PLD(Karachi) 726}
৩।এরপর সনাক্তকারীকে একা ডেকে এনে অভিযুক্তকে খুঁজে বের করতে দিতে হবে। সনাক্তকারীকেএমন জায়গায় রাখতে হবে যেন সে সবাইকে দেখতে পায় কিন্তু তাকে কেউ দেখতে না পায়।
৪। বিচারাধীন কয়েদী এবং আটক সন্দেহজনক ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরিবেশ অনুকূল থাকলে সনাক্তকরণ পরীক্ষা কারাগারের ভেতরে করতে হবে।
৫। কোন কোন ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতেও সনাক্তকরণ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সাক্ষীদের বিশেষভাবে সত্যায়িত করতে হবে এবং তা ন্যায়সঙ্গত ও বিধিবদ্ধ হতে হবে।
যে যে মাধ্যমে সন্দেহজনক ব্যক্তিকে সনাক্তকরণ সম্ভব তাহা আলোচনা করা হলো
১। মোবাইল ফরেনসিক এর সকল প্রযুক্তি ব্যবহারপূর্বক সন্দেহভাজন অপরাধী শনাক্তকরণ করা যায়
২।সাইবার পুলিশিং সার্বিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সন্দেহভাজন অপরাধীদের শনাক্তকরণ করা যায়
৩। মডাস অপারেন্ডি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সন্দেহভাজন অপরাধীদের শনাক্তকরণকরা যায়।
৪। সার্কিট ক্যামেরা ব্যবহার করিয়া করা যায়।
৫। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করিয়া
৬। মুঠোফোন বিশ্লেষণপূর্বক সন্দেহভাজন অপরাধীদের শনাক্তকরণকরা যায়
৭। পায়ের ছাপ ও আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষাপূর্বক সন্দেহজনক অপরাধী শনাক্তকরণ করা যায়
৮। রক্ত, বীর্য ও লালা, চুল,ব্যবহিত পোশাক পরিচ্ছেদ, বিশ্লেষণের মাধ্যমে ডিএন এ নাক্তকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্দেহজনক অপরাধীদের শনাক্তকরণ করা যায়
৯। অপরাধীদের দর্শন ও কন্ঠস্বর বিশ্লেষণের মাধ্যমে সনাক্তকরণ করা যায়
১০। টি আই প্যারেডের মাধ্যমে সনাক্তকরণ করা যায়
১১। অপরাধীদের চেয়ারা বা দর্শন ও তার মুখের কন্ঠস্বর বিশ্লেষনের মাধ্যমে সনাক্তকরণ করা যায়।ar Blog By Adore Themes.
পরিশেষে বলা যায় সনাক্তকরন মহড়া হল এমন একটি বাস্তবমুখি পদ্ধতি যার দ্বারা প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত হয়। আইন ও আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে ভাবে সনাক্তকরণ মহড়া কার্যকর করার কথা বলা আছে সে ভাবে সন্দেহভাজন আটককৃত অপরাধের সাথে জড়িত অভিযুক্ত আসামিকে জেলখানার ভিতরে বাদী এবং সাক্ষী কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে নির্ধারিত দিন ও তারিখে সনাক্তকরা যায় তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত অনেকাংশে ত্বরান্বিত হবে।
তথ্য কণিকা
পুলিশ প্রবিধানমালা বেঙ্গল,১৯৪৩ প্রবিধান ১-১২৯০ পূর্ণাঙ্গ P.R.B. 1943- মোঃ মতিয়ার রহমান, পুলিশ আইন, বাংলাদেশ সংবিধান, ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, অনলাইন ল পোর্ট্রাল,উকিপিডিয়া, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad।
লেখক: অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।