সিরাজ প্রামাণিক: দোষ স্বীকারোক্তি অপরাধকারী কতৃর্ক স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে, বিনা প্ররোচনায়, কোনোরূপ প্রলোভন ছাড়া নির্ভয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বেচ্ছায় সত্য বক্তব্য পেশ করলে সেটা হবে দোষ স্বীকারোক্তি। তবে স্বীকারোক্তি লিখে রাখার সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে এটা স্বেচ্ছামূলক। শুধু অপরাধীর বক্তব্যই নয় বরং তার আচরণের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।
কোনো অপরাধজনক ঘটনার পুলিশি তদন্ত চলাকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বীকারোক্তির জন্য নিয়ে আসলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে ওই ব্যক্তিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানবেন উক্ত ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য ইচ্ছুক কি—না?
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যদি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন ওই ব্যক্তি স্বীকারোক্তি প্রদান করতে আগ্রহী তাহলে তাকে এ বিষয়ে চিন্তা—ভাবনার জন্য যুক্তিযুক্ত ন্যূনতম তিন ঘণ্টা সময় প্রদান করবেন। এ সময়ে উক্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবেন। ম্যাজিস্ট্রেট আসামির হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলে দিতে এবং পুলিশকে বাইরে চলে যেতে বলবেন।
এরপর ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে বলবেন, আপনি এখন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আছেন। আপনি অপরাধ স্বীকার করুন বা না করুন, আপনাকে পুলিশের কাছে দেওয়া হবে না, আপনাকে হাজতে রাখা হবে। পুলিশকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি লিখে তা তাকে পড়ে শোনাবেন। পড়ে শোনানোর পর উক্ত ব্যক্তি তা সঠিকভাবে লেখা হয়েছে বলে স্বীকার করলে তাতে তার স্বাক্ষর নেবেন। এমনকি স্বীকারোক্তি লেখার পরও যদি উক্ত ব্যক্তি তাতে স্বাক্ষর করতে রাজি না হন তবে তাকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা যাবে না এবং এ ক্ষেত্রে তার এটি স্বীকারোক্তি হিসেবেও গণ্য করা যাবে না।
সুতরাং পুলিশের মারধরের কারণে কোনো আসামি যেসব স্বীকারোক্তি দেয় সেগুলোর আইনগত ভিত্তি নেই। আদালতে সেগুলো সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সাক্ষ্য আইন এর ২৪ ধারা মোতাবেক ‘কোনো প্রলোভন, ভীতি প্রদর্শন বা সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হলে তা অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবে। ‘কোনো দোষ স্বীকার স্বেচ্ছাকৃত ও বিনা ভয়ভীতিতে হতে হবে।’
সাক্ষ্য আইন এর ২৫ ও ২৬ ধারা মোতাবেক ‘কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন অবস্থায় দোষ স্বীকার করলে এটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না।’ এই ধারার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যে অসহায় অভিযুক্তকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করা।
পুলিশ যাতে বে—আইনিভাবে কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে না পারে সে জন্য এই ধারা রক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করে। সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী, স্বীকারোক্তি সবসময় নিজে জড়িত করে প্রদান করতে হবে। নিজেকে জড়িত না করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলে তা স্বীকারোক্তি হিসাবে গণ্য হবে না।
কিন্তু সাক্ষ্য আইন ১৮৭২—এর ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশের কাছে আসামির দোষ স্বীকার অনুযায়ী কোনো অপরাধমূলক জিনিস যদি উদ্ধার করা হয় বা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে আসামী কর্তৃক দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার বিচার্য বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক কোন বস্তু বা আলামত যদি উদ্ধার করা হয় তাহলে ওই উদ্ধারকৃত অংশের বিবৃতি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,’আসামি পুলিশকে বলল, ‘আমি দা দিয়ে কোপ মেরে তাকে হত্যা করেছি এবং ওই দা পুকুরে ফেলে এসেছি।’ পুলিশ ওই দা পুকুর থেকে উদ্ধার করল, তখন আদালতে ওই বিবৃতির অংশ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইন গবেষক। ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com