আজ থেকে এগারো বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়েছিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমজীবী। আহত হন আরও প্রায় দুই হাজার মানুষ।
ভবন ধসে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজউক এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দুটি মামলা করে দুদক।
দীর্ঘ এগারো বছরে চারটি মামলার মধ্যে সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা নিষ্পত্তি হলেও বাকি তিনটি মামলা নিষ্পত্তির মুখ দেখছে না। এর মধ্যে হত্যা মামলা ও ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্য শুরু হলেও, অন্য মামলায় রয়েছে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ। আসামিপক্ষ বলছে, মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারহীনভাবে কারাগারে আটক রয়েছেন ভবন মালিক সোহেল রানা। অন্যদিকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির প্রত্যাশা রাষ্ট্রপক্ষের।
রানা প্লাজার হত্যা মামলা
রানা প্লাজা ধসের পরদিন সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন। এছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকারী আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার।
আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী।
মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, অন্য আসামি আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন। আসামিদের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকিরা জামিনে ও পলাতক রয়েছেন।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, মামলাটিতে অভিযোগ গঠনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান আট আসামি। এদের মধ্যে সাতজনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়। তবে আসামি হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে করা আবেদনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মামলার বাদী সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক ওয়ালী আশরাফের সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
বর্তমানে ঢাকার জেলা দায়রা জজ হেলাল উদ্দিনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ৮৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ গত ২১ এপ্রিল মামলাটিতে ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। আগামী ২৮ এপ্রিল মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে।
মামলাটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমদ্দার জানান, মামলাটিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দিলে আসামিরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যান। শুরু থেকে মামলাটি বিভিন্নভাবে সময় নষ্ট হয়েছে। অন্যান্য আইনগত বাধা পেরিয়ে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু সাক্ষীরা ঠিকমতো হাজির না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আদালত থেকে সাক্ষীদের বার বার সমন পাঠানোর পরেও তারা হাজির না হওয়ায় শেষমেষ অনেক সাক্ষীকে পুলিশ ধরে এনেছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৫৯৪ জন সাক্ষীকে মধ্যে প্রায় ৮৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছি। আরও ১০০ জনের মত সাক্ষ্য নেওয়া লাগতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করে চেষ্টা যাচ্ছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই মামলাটির বিচার শেষ হবে এবং ভিকটিমদের পরিবার ন্যায় বিচার পাবেন।
এদিকে মামলায় কারাগারে থাকা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে জামিন স্থগিতের আবেদন জানায়। ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ বছরের ১৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৪ বিচারপতির বেঞ্চ সোহেল রানার জামিন স্থগিত করেন। একই সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতকে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।
ইমারত আইনে রাজউকের মামলা
আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
এদের মধ্যে আসামি ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মামলাটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এছাড়া মামলার আরেক আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহর পক্ষে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর এক বছরের জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় অভিযোগ গঠনের প্রায় আট বছর পরও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
এ বিষয়ে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল বলেন, গত বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজের বিচারক এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালত বিচারিক ক্ষমতা বলে হত্যা মামলার পাশাপাশি ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটিও নিয়ে যান। যাতে একইসাথে দ্রুত এই দুই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। তবে উচ্চ আদালতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি। ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল এখানেও সেই পর্যায়েও রয়েছে। এই মামলায় আসামির সংখ্যা ১৬ জন। সকলেই জামিনে রয়েছেন।
এসব বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় আট বছর আগে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটিতে এক আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। মামলা দুইটির বিচার শেষ না হওয়ায় আসামি সোহেল রানা কারামুক্ত হতে পারছেন না। তার মতে আসামি সোহেল রানা বিচারহীনভাবে কারাগারে আটক রয়েছেন বলে জানান তিনি।
ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রানা প্লাজা নির্মাণে ছয় তলার অনুমোদন থাকলেও আট তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এ কারণে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ এস এম জিয়াউর রহমানের আদালতে বিচারাধীন। এ মামলায় মোট ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছেন আদালত। সর্বশেষ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক এম এ মফিদুল ইসলামের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত। তবে তার জেরা শেষ না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল জেরা ও পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।
এ বিষয়ে আসামি রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, এটা একটি দুর্ঘটনার মামলা। সেই মামলায় রানা গত ১১ বছর ধরে জেলহাজতে রয়েছে। বাকি সবাই জামিনে পেলেও রানা জামিন পাচ্ছেন না। মামলার রায়ে যা হওয়ার তাই হবে। এভাবে বিনা বিচারের ১১ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই আদালতের উচিত হয়তো মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করা, নয়তো আসামিকে জামিন দেয়া। আশা করছি এ মামলার রায়ে রানাসহ অন্যান্য আসামিরা খালাস পাবেন।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পরবর্তী কার্যক্রম শেষে মামলাটির বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করছি।
এ মামলায় অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার এবং রেজাউল ইসলাম।
জ্ঞাতআয় বহির্ভূত সম্পদের মামলা
এই তিন মামলার বাইরে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটিই কেবল নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাতআয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়।
২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ মামলার রায় ঘোষণা ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর তৎকালীন বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেন আদালত।