‘অসদাচরণ’ ও ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া নরসিংদী সদরের সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাসকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ।
সাময়িক বরখাস্ত সাব-রেজিস্ট্রার (বর্তমানে নিবন্ধন অধিদপ্তরে সংযুক্ত) নীহার রঞ্জন বিশ্বাসকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি মোতাবেক উক্ত বিধিমালার বিধি ৪/৩ (ঘ) অনুযায়ী তাকে চাকরি হতে বরখাস্ত করা হয়।
এ বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ারের সই করা প্রজ্ঞাপন গত ২৫ এপ্রিল জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেহেতু, নীহার রঞ্জন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিবি রাখ) মোতাবেক যথাক্রমে অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ আনয়নপূর্বক ০১/২০২২ নং বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। এবং কেন তাকে চাকরি হতে বরখাস্ত করা হবে না, সে মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।
যেহেতু নীহার রঞ্জন বিশ্বাস উক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে প্রস্তাবিত শাস্তি প্রদানের বিপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি প্রদর্শন করতে পারেননি। যেহেতু তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক নীহার রঞ্জন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও ‘দুর্নীতি’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনাক্রমে কর্তৃপক্ষ যেহেতু নীহার রঞ্জন বিশ্বাসকে অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করে কেন তাকে চাকরি হতে বরখাস্ত করা হবে না, সে মর্মে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়। যেহেতু অভিযুক্ত কর্মকর্তা উক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের বিপরীতে প্রস্তাবিত শাস্তির বিরুদ্ধে সন্তোষজনক জবাব প্রদান করতে ব্যর্থ হন।
যেহেতু অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ে পত্র প্রেরণ করা হলে কমিশন প্রাপ্ত কাগজপত্রাদি পরীক্ষান্তে নীহার রঞ্জন বিশ্বাসকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৪ (৩) (ঘ) অনুযায়ী চাকরি থেকে বরখাস্ত শীর্ষক গুরুদণ্ড প্রদানে আইন ও বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।
সেহেতু বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী নীহার রঞ্জন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩(খ) ও ৩(খ) মোতাবেক যথাক্রমে ‘অসদাচরণ’ ও ‘দুর্নীতি’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় উক্ত বিধিমালার বিধি ৪/৩ (ঘ) অনুযায়ী তাকে চাকরি থেকে বরখান্ত করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
যোগ-বিয়োগের কারসাজিতে কোটি কোটি টাকা লোপাট
যোগফলের অভিনব কৌশলে প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ২ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার ৯৮২ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন নরসিংদী সদরের বরখাস্তকৃত সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস।
এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০২৩ সালের ১৩ মার্চ দুদকের গাজীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান।
সরকারি ফি বইয়ে উৎসে কর বাবদ আদায়কৃত অর্থের প্রকৃত যোগফল কম দেখিয়ে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ২ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার ৯৮২ টাকা আত্মসাৎ করেন বরখাস্ত হওয়া সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন। এ পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার বিষয়টি প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
এ বিষয়ে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট একটি অনলাইন পত্রিকায় ‘যোগ-বিয়োগের কারসাজিতে কোটি কোটি টাকা লোপাট!’- শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় অনুসন্ধানে নামে দুদক। তবে মামলা দায়ের করা হলেও ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নকলনবিশ শফিকুল ইসলামকে আসামি করা হয়নি।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল সম্পাদনকালে উৎসে কর, স্থানীয় সরকার কর, রেজিস্ট্রেশন ফি ও স্ট্যাম্প ডিউটি ফি বাবদ সরকারি রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। আদায় করা অর্থ বা পে-অর্ডার দিনভিত্তিক পৃথক রেজিস্ট্রার মোতাবেক লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে প্রকৃত আদায় করা পে-অর্ডারগুলোর অর্থ ব্যাংকে পরিমাণে কম জমা দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এতে দেখা যায় দিনশেষে ফি বইয়ে প্রদত্ত যোগফল প্রকৃত যোগফল অপেক্ষা কম। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ফি বইয়ে কৌশলে যোগফল কম দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রকৃত আদায়ের যোগফল অপেক্ষা কৌশলে যোগফল কম দেখিয়ে ১১ মাসে ২ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার ৯৮২ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
নরসিংদী সদর সেই সময়ের সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দলিল নিবন্ধন সম্পাদনকালে ২০০১ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত স্ট্যাম্প ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় কর, উৎসে কর খাতের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২১ সালের ৩০ মার্চ অভিযান পরিচালনা করে দুদকের একটি দল।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম ও উপ-সহকারী পরিচালক ওয়াহিদ মঞ্জুর সোহাগের সমন্বয়ে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওই কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল।