'আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচার'- আইনি নীতির পরিপন্থি কিনা?
সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ

‘আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচার’- আইনি নীতির পরিপন্থি কিনা?

সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ: একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির মামলা চলমান থাকা অবস্থায় অনুপস্থিত থাকলেও সুনির্দিষ্ট আইনের অধীনে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার পদ্ধতি রয়েছে। প্রশ্ন থেকে যায় আসামীর অনুপস্থিতিতে মামলা চলমান থাকলে আসামী ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হবেন কিনা অথবা আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচার ন্যায় বিচার পরিপন্থী কিনা? বাদী পক্ষে একতরফা বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে আসামী পক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কিনা অথবা আসামী অনুপস্থিত থাকলে বাদী কি বিচার পাবেন না?

আইনের নীতি হচ্ছে— No  men should be punished unheard or No men should be condemned unheard. এই নীতিটি এসেছে “Audi Alteram Partem” ” “ল্যাটিন ভাষা যাহার ইংরেজী অর্থ “hear the other side”—“অপর পক্ষকে শুনা” অর্থাৎ আদালত উভয় পক্ষকে শুনে বিচার করবেন। এই নীতির কথা থাকলেও যদি একজন আসামী পলাতক থাকে তাহলে কি তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকবেনা?

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর যদি আদালতকে সম্মান প্রদর্শন বা শ্রদ্ধা দেখিয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করেন বা আদালতে হাজির না হন বা আদালতের আদেশ মোতাবেক হাজির হয়ে তার বক্তব্য পেশ না করেন তবে ঐ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পলাতক আসামী হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। বিচার নিষ্পত্তির জন্য বাদী মামলা দায়েরের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকলেও যাতে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার কার্যক্রম শেষ করতে পারে সেই লক্ষ্যে একজন পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া বিধিবদ্ধ আইনগতভাবে চলমান থাকে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “Every person accused of a criminal offence shall have the right to a speedy and public trial by an independent and impartial Court or Tribunal established by Law” অর্থাৎ ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হবেন।”

আমাদের দেশের আইন ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৯(খ) ধারা মোতাবেক একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিচার পরিচালিত হয়। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হওয়ার পর যদি ঐ অভিযুক্ত ব্যক্তি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অথবা নিজেকে গোপন রাখছেন বলে আদালত মনে করেন তবে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৮৭ ধারা মোতাবেক হুলিয়া (Proclamation) জারী করতে পারেন এবং পরবর্তীতে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৮৮ ধারায় সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ প্রদান করতে পারেন।

আরও পড়ুন: সিনিয়র আইনজীবী পরিচয়ে ১৭ বছর ধরে আইন পেশায়; অবশেষে ধরা পড়লো টাউট

আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হলে হুলিয়া বা ক্রোক এর বিধান সমূহ সঠিকভাবে পালন করা না হলে মামলার পরবর্তী কার্যক্রম এখতিয়ার বহির্ভূত (Coram Nonjudice) ও বাতিল বলে গণ্য হবে। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৩৩৯ খ ধারার বিধানাবলী পালন না করা প্রাকৃতিক ন্যায় বিচার নীতির লংঘন। (Ref: 42 DLR 162)।

বিচার স্টেইজে একজন পলাতক আসামীর ক্ষেত্রে বাদীর আনীত সাক্ষী বা রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ নাই তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম রহিয়াছে তাহা হলো হত্যা মামলা বা Capital Punishment এর মামলার ক্ষেত্রে আদালত কতৃর্ক একজন State Defence Lawyer (SDL) নিয়োগ করা হয়। এছাড়া দুই বা ততোধিক আসামী থাকলে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৪০ক ধারা মোতাবেক আসামীর অনুপস্থিতিতে একজন লইয়ার এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে বিচার চলমান রাখার বিধান রয়েছে এবং ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ২০৫ ধারায় একজন ম্যাজিষ্ট্রেট আসামীর ব্যক্তিগত হাজিরা রেহাই দিতে পারেন আসামী পক্ষে একজন লইয়ার এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের ফৌজদারী আইনের ৩৩৯ খ ধারা ব্যতীত বিশেষ কিছু আইনে অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান রয়েছে। যেমন: বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ধারা ২৭(৬) ও ২৭(৬এ) তে অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৬৯ ধারায় এবং আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ এর ১১ ধারায় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২১ ধারায়ও আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়ার একই বিধান উল্লেখ রয়েছে।

অনুপস্থিতিতে বিচার বা Trail in Absentia হল একটি আইনের আদালতে ফৌজদারী কার্যধারা। থিঙ্ক—ট্যাঙ্ক ওপেন ইউরোপের পিটার ক্লেপের মতে “আইনি ব্যবস্থার কিছু গ্যারান্টি রয়েছে যা নিশ্চিত করে যে এটি ন্যায্য, যে প্রতিরক্ষার অধিকারগুলি লঙ্ঘন করা হচ্ছে না, তখন নিশ্চিত করে যে, ন্যায় বিচার করা হচ্ছে। অনুপস্থিতিতে রায় সাধারণ …আপনি এটি সমালোচনা করতে পারেন, তবে এটি বেশ সাধারণ।”

আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ: হাইকোর্ট

“কলোজা বনাম ইতালি” মামলায় ১৯৮৫ সালের রায়ে, ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত জোর দিয়েছিল যে ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি শুনানীতে অংশ নেওয়ার অধিকারী। এই এনটাইটেলমেন্টটি একটি ন্যায্য বিচারের অধিকার এবং একটি প্রতিরক্ষার অধিকারের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে। তদ্ব্যতীত, আদালত জোর দিয়েছিল যে, অনুপস্থিতিতে দোষী সাব্যস্থ একজন ব্যক্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে গেলে নতুন করে বিচারের অধিকারী হবে। ২০০৯ সালে মিশরীয় সন্ত্রাসী সন্দেহ ভাজন ওসামা হাসান মুস্তফা নাসরকে অপহরণের জন্য মিলানের আপিল আদালতের দ্বারা একজন প্রাক্তন সিআইএ স্টেশন প্রধান এবং অন্য দুই আমেরিকানকে অনুপস্থিতিতে বিচার এবং দোষী সাব্যস্থ করা হয়েছিল।

অনুপস্থিতিতে দোষী সাব্যস্ত কিছু ব্যক্তির উদাহরণ হল: মার্টিন বেকারম্যান, নাৎসি কর্মকতা এবং হিটলারের ব্যক্তিগত সচিব, যুদ্ধাপরাধ এবং নুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। জন ফ্যাক্টর, একজন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান গ্যারেন্টার এবং কন ম্যান ইংল্যান্ডে সিকিউরিটিজ জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে পালানোর পর অনুপস্থিতিতে ২৪ বছরের কারাদন্ডের বিচার ও সাজা হয়।

প্রাক্তন পাকিস্তানি ক্রিকেটার খালিদ লতিফকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডাচ আদালতের দ্বারা ১২ বছরের কারাদন্ডে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল ডাচ রাজনীতিবিদ গির্ট ওয়াউন্ডার্সকে হত্যার প্ররোচনা দেওয়ার জন্য, উস্কানি দেওয়ার জন্য এবং হুমকি দেওয়ার জন্য। এতে পরিলক্ষিত হয় আসামীর অনুপস্থিতিতে বিচারের কনসেপ্টটি বহু বছরের পুরোনো এবং ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিচার ব্যবস্থা ন্যায় বিচার পরিপন্থি নয় এবং আইনের নীতির পরিপন্থি না বরং এটি সংবিধান ও আইন অনুযায়ী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট সময়ে বিচার পাওয়ার অধিকার হতে যাতে বিচারপ্রার্থী বঞ্চিত না হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করে। এটি একটি পরিপূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া।

লেখক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ