মনজিলা সুলতানা: ধর্ষণ একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর তার প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সমাধান ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে সেই অপরাধী সাথে দেয়া একটি জঘন্য কাজ। ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে এই সমাধান যে একটি মেয়ের জন্য কতটা অপমানজনক ও ভয়ের, তা পরিবার কিংবা সমাজের উপলব্ধির বাইরে। ভয়ংকর মন মানসিকতার একজন ব্যক্তির সাথে ভিকটিমকে সহবাস ও বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। আমরা জানি আইনে ধর্ষণের অপরাধ আপসযোগ্য নয়। কিন্তু হরহামেশাই আপষ নামের এই অবিচার চলছে।
সমাজপতিদের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টায় ধর্ষকের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরী–নারীকে ধরেবেঁধে বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে। সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার কারবারে এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভরসাস্থল হিসেবে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাও এমন দীক্ষা নিচ্ছেন, চর্চা করছেন। ঠিক করে দিচ্ছেন, কখন কোথায় কীভাবে কত টাকা দেনমোহরে এসব অমানবিক ‘বিয়ে’ হবে। ক্ষতিগ্রস্ত নারী বা অপ্রাপ্তবয়স্করা শিশুরা যেন নিতান্তই পাপোশ, অন্য কোথাও যায়গা হয়না বিধায় পায়ের নিচে রাখার মত করে অপরাধীর সাথেই তাদের বিয়ে দেয়া হয়। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা ও সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ভিকটিমকে হয়রানির কারণেই ধর্ষণ মামলার সময়মত, সঠিক বিচার হয় না।
এ ছাড়াও ধর্ষণ মামলার আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে বড় একটি কারণ বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামিপক্ষের সমঝোতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু দরিদ্র পরিবারের। আর্থিক প্রলোভনে তারা সমঝোতা করে। সামাজিকভাবে লজ্জা ও ভয়েও মীমাংসায় আগ্রহী হয় তারা। আবার অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষা বা প্রমাণ সংগ্রহের অভাবেও ভিকটিমের পক্ষে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা বাধ্য হয়েই অভিযুক্তের শর্ত মেনে সমঝোতায় যেতে বাধ্য হয়। আর যেহেতু সমাজ এবং মাঝেমধ্যে বিচার ব্যবস্থাও মনে করেন যে ধর্ষণ মামলার কোন কোন আসামি ‘নিরপরাধ’ বা হঠাৎ করে ধর্ষণ করেছে, তখন স্বভাবতই ভুক্তভোগীরা অপরাধী প্রমাণিত হয়ে যায়। কারণ ভিকটিম এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে ধর্ষণ সংঘটিত হয়।
আমরা দেখেছি ধর্ষকের পক্ষে প্রচলিত ধারণা বা কুযুক্তি বা মিথগুলো হচ্ছে, নারীরা সবসময় ধর্ষণ নিয়ে মিথ্যাচার করে। কারণ তারা যৌনক্রিয়া করে অপরাধবোধে ভোগে বা তারা আলোচিত হতে চায়। তাছাড়া কেউ যদি চিৎকার না করে বা আক্রমণকারীকে আঘাত না করে বা তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি না করে তবে এটা ধর্ষণ হবে না। কিন্তু আমরা জানি যে যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে সব সময় অবশ্যই সঙ্গীর সম্মতি লাগবে। যে কোনোধরণের সম্পর্কে থাকা অবস্থাতেও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন অপরাধ। এমনকি বৈবাহিক জীবনে স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়াও একজন নারীর কাছে খুবই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
একজন ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হলে সেই মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এমনও দেখা গেছে বিয়ে করার পর ধর্ষকের জামিন হয়ে গেলে, সে মেয়েটিকে তালাক দিয়ে দেয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে, নির্যাতিত নারীকেই ‘ভোগ করা’র কী চমৎকার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েটি নিঃসন্দেহে তার বিবাহিত জীবনেও এভাবেই ধর্ষণের শিকার হতে থাকবে। অন্যদিকে অপরাধীরাও ভাবে ধর্ষণ করলে বিচারের পরিবর্তে বিয়ের পথ তো খোলা থাকলোই।
আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা এবং ধর্ষণ অপরাধ কি আপষযোগ্য কি?
প্রথমেই আমরা আইনে এই অপরাধ এর আইনগত সংজ্ঞা জানবো। বাংলাদেশে ধর্ষনের সংজ্ঞা মুলত দুইটি আইনে দেয়া আছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সংজ্ঞা
যদি কোন পুরুষ বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
দন্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণ এর সংজ্ঞা
কোন পুরুষ নিম্নোক্ত পাঁচটির যেকোন অবস্থায় কোন স্ত্রীলোকের সাথ যৌনসঙ্গম করলে সে ধর্ষণ করেছে বলে পরিগণিত হবে।
প্রথমত:- স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে;
দ্বিতীয়ত:- স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে;
তৃতীয়ত:- স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে স্ত্রীলোকটির সম্মতি আদায় করা হলে;
চতুর্থত– স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে যে, সে স্ত্রীলোকটি স্বামী নয়, এবং পুরুষটি তা জানে যে, স্ত্রীলোকটি তাকে এমন অপর একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে, যে পুরুষটির সাথে সে আইন সম্মতভাবে বিবাহিত হয়েছে বা বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে;
পঞ্চমত:- স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যতি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বৎসরের কম হয়। এখন আলোচনায় আসা যাক ধর্ষণ অপরাধ কি আপষযোগ্য অপরাধ কি না? না এটি আপষযোগ্য অপরাধ নয়। এবং আইনেই বলা আছে এটি আপোষযোগ্য অপরাধ নয়। বাংলাদেশের আইনে যেই অপরাধসমূহ আছে, তার মধ্যে ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যার কোনো আপোষ-মীমাংসার সুযোগ নেই। সাধারণ অবস্থায় শুধু না , বিচারাধীন থাকাবস্থায় ধর্ষণ মামলায় আপোষ করার ক্ষমতা কারো নেই। যেখানে আইনে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনায় কোনো আপোষ-মীমাংসার প্রশ্নই আসে না, সেখানে ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় আপোষ করার এই অলিখিত নিয়ম বছরের পর বছর চলে আসছে। ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বিয়ে কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না।
কেন সমাজে ধর্ষণ মামলার আপষ হয়, যেটা হয় তা আপোষের নামে ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে কি অনৈতিক ও অসম্মানজনক নয়?
আমাদের দেশে সামাজিক অবস্থায় একজন ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার খুব ট্যাবুর মধ্যে থাকেন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার পর। তারা ভাবতে বাধ্য হন মামলা করবেন কিনা, সবার সামনে যাবেন কিনা, বিচারের মুখোমুখি হবেন কিনা, মামলার ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন কিনা, আসামী পক্ষ শক্তিশালী কিনা ইত্যাদি। এইসব ভাবনাচিন্তাতেই পার হয়ে যায় বেশ কিছুদিন। তারা ভাবতে থাকেন যে, এটাই আমাদের কঠিন বাস্তবতা। যে নারী-কিশোরী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হন, প্রথমেই তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ট্রমায় চলে যান। ধর্ষণের পর বেশিরভাগ ভিকটিমের পরিবার এবং তার আত্মীয়স্বজন ও পারিপার্শ্বিক কারণে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
ঘটনা গোপন করার জন্য বা অপরাধীরা শক্তিশালী হলে পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে বেশিরভাগ ভিকটিমকে দীর্ঘ সময় আটকেও রাখা হয়। তাই ধর্ষণের শিকার নারী-কিশোর বা শিশু সময়মতো মামলা বা অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মামলাটাও থানা নিতে চায় না। অনেক সময় নিজ খরচে কেউ মামলা করলেও বছরের পর বছর আদালতে চলতে থাকে সেই বিচার। তখন বাধ্য হয়ে আপোষ মিমাংসায় যেতে বাধ্য হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় মোড়লেরা সালিসি বৈঠকে আপোষ করে দেন। স্থানীয় প্রশাসনও জোরালো পদক্ষেপ নেয় না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত নারী–শিশুরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। আমাদের সমাজে ধর্ষণ মামলার আপোষ-মীমাংসার নামে যেটা হয়, সেটা হলো বিভিন্ন মহল থেকে নানা চাপ দেওয়া ও টাকার লোভ দেখিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার একটি উপায় বের করা। সে ক্ষেত্রে এ বিয়ের প্রস্তাবটাও একধরনের প্রলোভন। অসহায় ভিকটিমের পরিবার তখন আপোষকেই সমস্যার সমাধান ভেবে রেহায় পান।
ভিকটিম ব্লেমিং ধর্ষণ মামলার আপষ এর একটি বড় কারণ
কেন ধর্ষণ মামলার বিচারের দেরি হয় বা বিচার ঝুলে যায়, এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় বেশিরভাগ সাক্ষী হাজির না হওয়াতে ধর্ষণ মামলার তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে নারাজ। অভিভাবকদের এই দারিদ্রের সুবিধা নেয় আসামিপক্ষ। এছাড়াও ভিকটিম ব্লেমিং ধর্ষণ মামলার আপষ এর একটি বড় কারন।
ভিকটিম ব্লেমিং শব্দটি সমাজে সব শ্রেণির কাছে বোধগম্য না হলেও পরোক্ষভাবে কম-বেশি এর চর্চা সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দ্বারাই হয়ে থাকে। আমাদের আশপাশে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে থাকলে অপরাধীকে নয়, বরং যার সঙ্গে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে তাকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একটি মেয়ে বা নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন সমাজ তাকেই সবচেয়ে আগে দায়ী করে।
হয় মেয়েটির পোশাককে, না হয় চলাফেরাকে, চাকরি করাকে, পর্দা মেনে না চলাকে, পরিবেশ-পরিস্থিতিকে, স্বভাব-চরিত্র বা আচার-আচরণ এমনকি চেহারাকেও দায়ী করে। ধর্ষণকারীকে কখনোই দায়ী করা হয় না। যেমন কিছুদিন আগে চলন্ত বাসে যখন একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হলেন, বলা হলো মেয়েটি একা কেন ভ্রমণ করছে, তাই এমন হতেই পারে। এর দুয়েকদিনের ভেতর আরেকজন নারীকে বাসে যখন গণধর্ষণ করা হয়, তখন তার স্বামীকে পাশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এবার তাহলে সেই মানুষগুলো কাকে দায়ী করবে? দেহ বিক্রি করাই যার পেশা, অর্থাৎ যৌনকর্মী, তাকেও ধর্ষণ করার অধিকার কারো নেই।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘Landmark Judgements on Violence against Women of Bangladesh, India and Pakistan’ শীর্ষক বইটিতে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেছিলেন যে, বিচারের সময় একজন রেপ ভিকটিমের মুখের কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেইসাথে গুরুত্ব দিতে হবে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদিকে। যারা যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন কোনো খদ্দের যদি কোনো যৌনকর্মীকে জোর-জবরদস্তি করে, তবে সেই খদ্দেরকে সবাই মিলে প্রতিহত করে। কারণ যৌনকর্মীরও অধিকার আছে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার। যদিও তারা পয়সার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করেন। কাজেই একজন যৌনকর্মীও যদি অভিযোগ করেন যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পুলিশকে সেটাও তদন্ত করতে হবে।
ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যা শুধু ভিকটিমকে নয়, পুরো সমাজকে আঘাত করে।
ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারী ভিকটিমের বিয়ে ও আপোষ
সংক্রান্ত কিছু সাম্প্রতিক বাস্তবিক ঘটনা
বাংলাদেশের আইনে কিছু অপরাধ আছে যেখানে কোনো আপোষ করার সুযোগ নেই, ধর্ষণের ঘটনা তেমনি একটা।যেখানে দেশের আইনে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনায় কোনো আপোষ -মীমাংসার প্রশ্নই আসে না, সেখানে এ রকম মামলা ট্রাইব্যুনালে/আদালতে ওঠে কীভাবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের নির্দেশে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারী ভিকটিমের বিয়ে ও আপোষ সংক্রান্ত কিছু ঘটনার বিবরণ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলোঃ
২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একটি আদালতে ১৪ বছরের একটি কিশোরী তার প্রতি জঘন্য অন্যায়ের বিচারের দাবিতে আদালতে বসে ছিল।ধার্যদিনে উভয় পক্ষের আপসনামা দাখিল করা হয়। বিচার প্রার্থী এই ১৪ বছরের মেয়েটি একটি শিশু, অথচ হতভাগ্য এই শিশুটিই এখন আরেকটি শিশুর মা। মেয়েটি বাল্যবিবাহের শিকার হয়নি, সে হয়েছিল ধর্ষণের শিকার। দুই বছর আগে ১২ বছরের এই কিশোরীকে ধর্ষণ করে ৫৫ বছর বয়সের মুদি দোকানদার আনোয়ারুল ইসলাম। এ নিয়ে মামলা হয়, আসামিও গ্রেপ্তার হয়। বিচার চলমান অবস্থায় ওই কিশোরী একটি মেয়েসন্তান জন্ম দেয়। এই কিশোরী মেয়েটি জানেও না তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় অসম্মান।
শিশুটি একবার ধর্ষণের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হয়েছে, এরপর মা হয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে এবং এখন তাকে দাঁড় করানো হয়েছে তারই ধর্ষককে বিয়ে করার জন্য। এ মামলার আসামি পাড়ার বয়স্ক এক দোকানদার, যাঁর পরিবারে স্ত্রী ও সন্তান আছে। দুই বছর ধরে তিনি কারাগারে। এ অবস্থায় দুই পক্ষই একটি আপষ মিমাংসায় আসতে চাইছে, দুই পক্ষই বিয়ের বিষয়ে সম্মত বলে জানিয়েছে। মেয়ের পরিবার চাইছে, মেয়েটিকে একজনের হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে, আর অপরাধী চাইছে বিয়ে করে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে।
২০২২ সালের মার্চে পঞ্চগড়ে বিধবা এক নারীকে (৩৭) ধর্ষণের দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল পুলিশের এক উপপরিদর্শককে (এসআই)। পঞ্চগড় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক ওই নারীকে বিয়ের শর্তে জামিন দেন এসআই আবদুল জলিলকে। আসামির প্রথম স্ত্রীও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।
২০২১ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীর সঙ্গে বিয়ের শর্তে এক বছর কারাভোগের পর জামিন পান নাজমুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। জামিনের পর কাজির মাধ্যমে আদালতে বিয়ে হয় তাঁদের।
২০২১ সালে লালমনিরহাটের রাকিবুজ্জামান ৩বিঘা জমি লিখে দেওয়ার পর নাবালিকা অপহরণ মামলায় গত বছরের ১২ ডিসেম্বর জামিন পায়। এখানেও শর্ত বিয়ে। জেল সুপারের উপস্থিতিতে কারাগারে বিয়ের কাবিন হয়। আদালতে না পাঠিয়ে স্রেফ চড়–থাপ্পড় আর জরিমানা করে ধর্ষকদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের এক কৃষকের মেয়ে (স্কুলছাত্রী) ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়।
গ্রামের সমাজপতিরা জানিয়ে দেন, তাঁদের বিচার মেনে নিতে। থানায় অভিযোগ করলে গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না। পরে ওই বছরের ১৬ জুন সালিস বৈঠক করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিন থাপ্পড় ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রীর স্বজনেরা জানান, ধর্ষক ও তাঁর স্বজনেরা গ্রামে প্রভাবশালী হওয়ায় এমন বিচার মেনে নিতে হয়েছে তাঁদের।
২০২১ সালে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের এক কৃষকের মেয়ে (স্কুলছাত্রী) ধর্ষণের শিকার হয়। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের এক কৃষকের মেয়ে (স্কুলছাত্রী) ধর্ষণের শিকার হয়। গ্রামের সমাজপতিরা জানিয়ে দেন, তাঁদের বিচার মেনে নিতে। থানায় অভিযোগ করলে গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না। পরে ওই বছরের ১৬ জুন সালিস বৈঠক করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিন থাপ্পড় ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির লংগদু উপজেলার করল্যাছড়িতে জমির বিনিময়ে ধর্ষকের জামিন হয় যা গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়।
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির লংগদু উপজেলার করল্যাছড়িতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক স্কুলছাত্রী ছাগল খুঁজতে গেলে আর এস উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রহিম তাকে ধর্ষণ করেন। সে সময় স্কুলের ছাত্রাবাসে কেউ ছিল না। বিষয়টি কাউকে না জানাতে স্কুলছাত্রীকে হুমকি দেন ওই শিক্ষক। ঘটনার ৯ দিন পর ৫ অক্টোবর ধর্ষণের শিকার ছাত্রীর পরিবার লংগদু থানায় মামলা করে।
২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর আবদুর রহিমকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন রাঙামাটির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল,একই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আবদুর রহিম। পাশাপাশি জামিন আবেদন করেন। গত বছরের ৮ জুলাই ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েশিশুটিকে এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে আবদুর রহিমকে (৪৬) তিন মাসের জামিন দেন আদালত। সঙ্গে ছিল বিয়ে করার শর্ত।
২০২০সালে ফেনীতে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক এক ব্যক্তি ওই কিশোরীকে বিয়ে করতে চাইলে আদালত তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত দেন এবং পরে ওই লোকের জামিনও হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্তর স্বজনেরা জানান, ধর্ষক ও তাঁর স্বজনেরা গ্রামে প্রভাবশালী হওয়ায় এমন বিচার মেনে নিতে হয়েছে তাঁদের। ধর্ষণের শিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনায় আপসের বিষয়টি বিচারিক আদালতে উঠে আসছে। প্রান্তিক মানুষের কাছে এটি একটা ভুল বার্তা পৌঁছাবে যে ধর্ষণের ঘটনায় বছর কয়েক জেল খেটে পার পাওয়া যায় কোনো সালিস হয় না। ধর্ষণের পর বিয়ে কতটা ন্যায্য এবং শিশুর অধিকার সংবেদনশীল প্রস্তাব, তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে।
শর্ত সাপেক্ষ জমিন এবং বিয়ের শর্তে জামিন এক কি?
না। দুটি দুই ধরনের শর্ত। সাধারণত জামিনের কিছু শর্ত আছে তা অপরাধীকে মানতে হয়। জামিনের শর্ত হলো এমন বিধি, যা জামিনে থাকাকালীন একজনকে অবশ্যই মেনে চলতে হয়, যখন আদালত তার মামলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জামিন অপরাধমূলক বিচারব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক বিষয়। জামিন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষাধিকার হলেও এটি অপব্যবহার করার সব সময় সুযোগ থাকে। যদিও জামিন সম্ভাব্য নির্দোষ ব্যক্তির অহেতুক দুর্ভোগ এড়ানো নিশ্চিত করে, এটি বিপরীতভাবে ন্যায়বিচারে প্রশাসনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জামিনে কিছু অন্তর্নিহিত শর্ত রয়েছে।
যেমন: অভিযুক্ত ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে হাজির হতে হবে, মামলার প্রমাণের ক্ষতি সাধন বা মিশ্রণ করতে পারবেন না, পালিয়ে যেতে পারবেন না, সাক্ষীদের হুমকি দিতে পারবেন না ইত্যাদি। এ ছাড়াও আদালত প্রায়শই অতিরিক্ত শর্ত জুড়ে দেয়। তবে এর সাথে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারী ভিকটিমের সাথে ধর্ষকের বিয়ে হলে জামিন দেবে এমন শর্ত আদালত দিতে পারেনা।
RKM Reza vs. State 33 DLR (1981) 146 মামলায় বলা হয়, জামিনে আসামির মুক্তির জন্য জামিন বন্ড জমা দেয়ার পরিবর্তে আদালত অর্থ জমা দিতে আদেশ করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে প্রদত্ত জামিন বৈধ হলেও জামিনে প্রদত্ত শর্ত বেআইনি বলে বিবেচিত হবে। ঠিক তেমনি ভাবে বলা যায় এমন কোন শর্ত দেয়া যাবে না যা যুক্তিযুক্ত নয়।
অন্য আরেকটি মামলা Keshab Narayan vs. The State AIR (1985) SC 166 মামলার রায়ে বলা হয়, জামিন দেয়ার সময় হাইকোর্টের এমন কোনো শর্ত আরোপ করা উচিত নয়, যেন শর্তটি দ্বারা জামিনকে অস্বীকার করার সমান মনে হয়। পাশাপাশি জামিনের শর্তগুলি কঠোর হওয়া উচিত নয়। এবং
AHM Siddique Vs. State 45 DLR (AD) মামলায় 1993 বলা হয়, আদালত জামিনে শর্ত হিসেবে জরিমানা দিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদেশ করতে পারেন না। এই ধরনের শর্তগুলো বেআইনি বলে বিবেচিত। জামিনের অপব্যবহার রোধে আদালতে বিচারকদের জামিন দেয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আদালতের যেসব বিষয়ে জামিন প্রদান করার ক্ষমতা আছে, তা সম্পর্কে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন কোন পক্ষ আপোষের নামে ধর্ষণের মত মামলা থেকে পার না পেয়ে যায়। যেসব মামলায় অভিযুক্তকে জামিন দেয়া যায়, তা শনাক্তকরণ এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণের একটি অংশ।
ধর্ষণ মামলা আপষের নামে এক ধরনের প্রলোভনঃ
আমাদের সমাজে ধর্ষণ মামলার আপোষ -মীমাংসার নামে লোভ দেখিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার একটি উপায় বের করা। সে ক্ষেত্রে এ বিয়ের প্রস্তাবটাও একধরনের প্রলোভন। ধর্ষণের মতো জঘন্য একটি অপরাধ করে অপরাধী পার পেয়ে যায়। যাকে ধর্ষণ করেছে, তাকেই বিয়ে করার অধিকার সমাজের আশকারা থেকে। সমাজ মানতেই চায় না যে, একজন ধর্ষকের সাথে জীবন কাটানো কতটা লজ্জার হতে পারে মেয়েটির জন্য। তাকে ধর্ষণ করার বিচার তো হলোই না, উপরন্তু অপরাধীর সঙ্গে সংসার করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির দরিদ্র পরিবার হয়তো ভাবেন বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির একটি হিল্লে হলো বা সমাজে মুখ দেখানোর একটা ব্যবস্থা হলো। তা না হলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে কোথায় যাবেন তারা, কে বিয়ে করবে তাকে?
অথচ এই সমাধান যে একটি মেয়ের জন্য কতটা অপমানজনক ও ভয়ের, তা পরিবার ভাবেই না। ভয়ংকর একজন দানবের সাথে তাকে সহবাস ও বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। শাস্তির যায়গায় অপরাধীকে পুরষ্কৃত করার এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া একজন বিচার প্রার্থী নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়া। এমন আচরণে একজন ভিকটিমের মনে দেশের বিচার–আচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিরুপ প্রভাব ফেলে। দিন দিন মানুষের আস্থার নিদর্শন বিচার ব্যবস্থাকেও অনাস্থা মনে হয়।
শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যই অপরাধী এবং তার পরিবার বিয়েকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। নির্লজ্জ সমাজ একবারও ভাবে না যে ধর্ষকের সঙ্গে জীবন কাটানোটা একজন নারীর পক্ষে কতটা লজ্জার ও কষ্এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারী ধর্ষণের বিচার তো পানই না, উপরন্তু অপরাধীর সঙ্গে সংসার করার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার যদি দরিদ্র হন, তাঁরা হয়তো ভাবেন, বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির একটি হিল্লে হবে বা সমাজে মুখ দেখানোর একটা ব্যবস্থা হবে। তা না হলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ভবিষ্যতে কে বিয়ে করবে? তাই বাদী ও বিবাদী ফয়সালা করে ভয়ংকর অপরাধকারীর সঙ্গে তাঁকে থাকতে বাধ্য করেন।
ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি
বাংলাদেশে আইনে ধর্ষণ অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন। এবং ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হলে ‘মৃত্যুদণ্ড’ সাজার বিধান আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, ৯ (১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তা হলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তার কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে ও দণ্ডনীয় হবেন।
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তা হলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-
(ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষণের শিকার হন, তা হলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষণের শিকার নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনি বা তারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীত হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
পরিশেষে, ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যা শুধু ভুক্তভোগীকে নয়, পুরো সমাজকে আঘাত করে। কাজেই সে রকম একটি অপরাধ করে অপরাধী বিয়ে করে পার পেয়ে যায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ বিচারব্যবস্থায় ধর্ষণকে যৌন সংসর্গ বা যৌন অনুপ্রবেশের অন্যান্য রূপ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা একজন অপরাধী দ্বারা সম্মতি ছাড়াই শিকার ব্যক্তির মতের বিরুদ্ধে করা হয়। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যে কোন দেশের আইন চর্চায় আইনের ব্যত্যয়। ধর্ষণ দুর্বলের ওপর সবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। যখন সর্বশেষ ভরশা আদালত পাড়ায় ও আপোষ মিমাংসার নামে ধর্ষণকারীর সাথে বিয়ে একধরণের প্রলোভন।
ধর্ষকের সাথে ভিকটিমের বিয়ে জামিনের একটা গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধীরা। এবং যখন ধর্ষণকারী এই কারনে জামিন পেয়ে যায় এর মাধ্যমে সমাজে একটা ভুল বার্তা যায়। কারণ যারা ধর্ষক, তারা মনে করে আমি ধর্ষণ করলাম এবং যাকে ধর্ষণ করলাম, তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে গেলাম। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের জন্য যে বিচার সেটা আর পেতে হয় না।এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব মামলার ফলোআপ থাকে না বলে অপরাধীর কোন জবাবদিহিতা করতে হয়না। সমাজ রাষ্ট্র তথা আমাদের বিচার ব্যবস্থা যদি একজন ভিকটিমকে ধর্ষকের ঘরে না পাঠিয়ে ভিকটিমের ভবিষ্যৎ এর দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে মনোযোগ দিলে সে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।