কিশোর গ্যাং নির্মূলে প্রচলিত আইন কতটুকু কার্যকর?
এম এ আরাফাত ভূঞা

শিশুশ্রম দূরীকরণে আইনের কি ভূমিকা?

এম এ আরাফাত ভূঞা: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিশুশ্রম একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ শিশু তাদের শৈশব হারিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত রয়েছে। শিশুশ্রম শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক বিকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। এটির পরিণতি শুধুমাত্র একটি প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং পরবর্তী প্রজন্মগুলোর ওপরেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে।

যখন শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়, তারা শিক্ষার সুযোগ হারায় এবং এর ফলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে উন্নতির সম্ভাবনা কমে যায়। বিশেষ করে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এই সমস্যাটি বেশি প্রকট। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশেও শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার শিশু কর্মজীবী। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। পাশাপাশি ১০ লাখ ৬৮ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে। কৃষি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, মাছ ধরাসহ নানা খাতে তারা কাজ করছে।

এতে আরো বলা হয়েছে, দেশে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ শিশু শ্রমজীবী, যা ২০১৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। উৎপাদন খাতে ৩৩ শতাংশ, কৃষি নবায়ন ও মাছ ধরার কাজে যুক্ত আছে ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমজীবী শিশু। শিশুরা সবচেয়ে বেশি কাজ করছে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শ্রমজীবী শিশুদের সিংহভাগই ছেলে। তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশ নিজ নিজ বাড়িতে থেকে কাজ করে। তাদের গড় মাসিক আয় ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা। জরিপ থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, দেশে শিশুশ্রমের হার অনেকাংশে বেড়েছে।

প্রতিবছর ১২ জুন শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে আন্তর্জাতিক ভাবে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে এই কর্মসূচি নেয় এবং ২০০২ সালের ১২ই জুন থেকে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করা শুরু হয়। সেই থেকে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে পালিত হয় দিবসটি। শিশুশ্রম দিবসটি জুড়ে থাকে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য বিষয়। সে প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোও থাকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে।

বাস্তবিক অর্থে এই দিবসটি শুধুই কাগজে কলমে উদযাপন করা হচ্ছে। বাস্তবে শিশুদের দেখা মিলে, মোটর ওয়ার্কশপে, বাইকের গ্যারেজে, মুদি-মনোহরী দোকানে, ওয়েল্ডিং মেশিনের কারখানায় , রিকশা-সিএনজি চালানো অবস্থায়, বাস-ট্রাকের হেলপারিতে, নির্মাণকাজে, গৃহকর্মী হিসেবে, ইটের ভাটায় , হোটেল-রেস্টুরেন্টে, স্টিলের আলমারির দোকানে, রাস্তার পাশে ঝালমুড়ি,শরবতসহ বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকানে হাড়ভাঙা খাটুনিতে লেগে আছে তারা।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে এই শিশুরা। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের কারণে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর এই শিশুদের অল্প বয়সে কর্মদক্ষতা হারাবে এবং যখন প্রকৃত অর্থে তার কাজ করার কথা তখন সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অকেজো হয়ে দেশ গড়ার কারিগর হতে গিয়ে দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে যাবে। তাদের এই বোঝা হয়ে যাওয়া দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর তথ্য অনুসারে, সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মেয়ে এবং ছেলে এমন কাজে জড়িত যা তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবসর এবং মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে, এভাবে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। এই শিশুদের মধ্যে, অর্ধেকেরও বেশি শিশুশ্রমের নিকৃষ্ট রূপের মুখোমুখি হয়। শিশুশ্রমের এই নিকৃষ্ট রূপগুলির মধ্যে রয়েছে বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ, দাসত্ব, বা অন্য ধরনের জোরপূর্বক শ্রম, মাদক পাচার এবং পতিতাবৃত্তির মতো অবৈধ কার্যকলাপ, পাশাপাশি সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াও রয়েছে।

শিশুদের অধিকার রক্ষা, সুরক্ষা ও শিশুশ্রম বন্ধের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে নানা আইন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান, বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত ২০১৮), জাতীয় শিশুনীতি (২০১১), শিশু (শ্রমের অঙ্গীকার) আইন(১৯৩৩) ন্যূনতম মজুরি অধ্যাদেশ ১৯৬১, কারখানা আইন (১৯৬৫), দোকান ও স্থাপনা আইনসহ (১৯৬৫) নানা আইন প্রচলিত রয়েছে। উক্ত আইনগুলোতে শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়াও কিছু আইনে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে কর্মঘণ্টাও এবং শিশুকে দিয়ে কী কী কাজ করানো যাবে এবং কি কি কাজ করানো যাবে না তাও বলা আছে। শিশুদের জবরদস্তিমূলক শ্রম, শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করতে প্রতিশ্রুত হলে তাদের শাস্তির প্রসঙ্গেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখিত আইনগুলো শিশুর অধিকার রক্ষা ও শিশুশ্রম নিষিদ্ধে কি বলে সেটি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

১৮ অনুচ্ছেদে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা,২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র কোন প্রকার বৈষম্য দেখাবে না। শিশুদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে। ৩৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সব ধরনের জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ। সুতরাং শিশুদের যদি শ্রমে বাধ্য করা হয় তবে তাও আইনের চোখে দন্ডনীয় অপরাধ।

বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত-২০১৮) অনুযায়ী শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ আর কিশোরদের বয়স ১৪-১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। উক্ত আইনের ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। তবে কিশোর হলে শর্ত সাপেক্ষে কাজের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে যেকোন মুহূর্তে কিশোর নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে পারবে।

এই আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী, কোন অভিভাবক শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি দিয়ে চুক্তি করতে পারবে না। যদি করে সেক্ষেত্রে এটি অবৈধ চুক্তি বলে বিবেচিত হবে। যদি কোন ব্যক্তি ধারা ৩৪ অমান্য করে শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ দেয় বা অনুমতি দেয় তবে ঐ ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা এবং ৩৫ ধারার বিধান লঙ্ঘনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের দন্ডিত হবে। কিশোর শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কাজে নিয়োগ করতে হলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ নিতে হবে, যেটার খরচ বহন করতে হবে মালিককে।

উক্ত আইনের ৪১(৩) ধারায় উল্লেখ আছে যে, কিশোর শ্রমিকদের স্বাভাবিক কাজের সময় হবে ৫ ঘণ্টা। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না। এই আইনে ৪৪(১) ১২ বছর বযসের যেকোনো শিশুকে হালকা কাজে নিয়োগ করা যাবে কিন্তু কাজটি শিশুর স্বাস্থ্য ও উন্নতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারবে না ও উক্ত কাজটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণে বিঘ্ন ঘটাবে না। তবে শর্ত থাকে যে, শিশু যদি বিদ্যালয়গামী হয় তাহলে তার কর্মসময় এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন উক্ত কাজের কর্মসময় শিশুর বিদ্যালয় গমনকে বিঘ্নিত না করে৷

জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ এর ৮ ধারার ৮/৯ এ বলা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশু নিয়োজিত আছে, সেখানে শিশু যেন, কোনোরূপে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে।

শিশু (শ্রমের অঙ্গীকার) আইন, ১৯৩৩ অনুসারে পিতা বা অভিভাবক শিশুর শ্রম প্রদানের চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে বা শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করতে প্রতিশ্রুত হলে তারা দন্ডিত হবে।

ন্যূনতম মজুরি অধ্যাদেশ ১৯৬১-তে বলা হয়েছে, কিশোরসহ সব শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে এবং নিয়োগকারী কর্তৃক কিশোর শ্রমিককে (১৮ বছরের নিচে) এই অধ্যাদেশের আওতায় গঠিত বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের কম মজুরি প্রদান বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

কারখানা আইন (১৯৬৫) ধারা ২(গ) অনুযায়ী ১৬ বছরের কম বয়সীদেরকে শিশু বলা হয়। এই আইনের ৬৬ ধারা অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী কাউকে কারখানার কোন কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শুধুমাত্র সার্টিফিকেট দানকারী সার্জনের নিকট থেকে শারীরিক সক্ষমতার সনদপত্র পাবার পরই এ সকল শিশুকে কারখানার কাজে নিয়োগ করা যাবে।

সেক্ষেত্রে, উক্ত শ্রমিক বা শ্রমিকদেরকে একটি প্রতীক চিহ্ন বহন করতে হবে এবং কারখানার ম্যানেজার উক্ত সার্টিফিকেট সংরক্ষণ করবে। উক্ত আইনের ৭(১১) ধারায় উল্লেখ আছে, কোন শিশুকে দিয়ে দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশী কাজ করানো যাবেনা এবং তাদেরকে সন্ধা ৭ টা থেকে সকাল ৭ টা, এ সময় কালের মধ্যেও কাজ করানো যাবে না। ৫১ ধারার বিধান মতে প্রতিটি শিশু শ্রমিক সাপ্তাহিক একটি পূর্ণ দিবস ছুটি ভোগ করবে। এছাড়াও উক্ত আইনে বলা হয়েছে, কারখানার বিপদজ্জনক কোন কাজে শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না।

দোকান ও স্থাপনা আইন (১৯৬৫) দোকানে বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কমবয়সী শিশুনিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। উক্ত আইনে ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তির জন্য শ্রমঘণ্টাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

শিশুশ্রম দূরীকরণে ও তাদের অধিকার রক্ষায় নানা আইনের বিধান থাকলেও আইনের তোয়াক্কা না করে এর হার দিনদিন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুশ্রম প্রতিরোধে আইনে শিশুদের অধিকার রক্ষা নিয়ে নানা বিধান রয়েছে তা শিশুদের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি উদঘাটন করতে হবে, শিশুশ্রমে উৎসাহ প্রদানকারীদের আইনের আওতায় এনে শিশুশ্রমকে নিরুৎসাহিত করতে হবে, আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে এটি প্রতিরোধে সঠিক ও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।

আইনের দুর্বলতা ও এর যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার পাশাপাশি দরিদ্রতা, রাজনৈতিক বিপর্যয়, পিতৃবিয়োগ, অসাধু শ্রেণির অপতৎপরতা, মা-বাবার উদাসীনতা সমাজের নির্লিপ্ততা অনেকাংশে দায়ী। শিশুশ্রম একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা, যার সমাধান কেবল সরকার বা আইন প্রয়োকারী সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

দেশকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সকলকে দেশপ্রেম, সহমর্মিতা, এবং ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ও তাদের জন্য একটি সুরক্ষিত ও শিক্ষামূলক পরিবেশ তৈরি করতে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে এটির প্রতিরোধ এবং প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের সব শিশু নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকুক বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি।