জান্নাতুল ফেরদৌস পুলক: শিশু যৌন নিপীড়ন হল একটি গুরুতর অপরাধ। বিশ্বের অনেক জায়গার মতো বাংলাদেশেও শিশু যৌন নিপীড়ন একটি জটিল সমস্যা যা শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাঁধা প্রদান করে এবং কঠোর আইনি কাঠামোর দাবি করে। বাংলাদেশে শিশু যৌন নির্যাতন যদিও সামাজিক কলঙ্ক, সাংস্কৃতিক নিষিদ্ধতা কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসম্মান অথবা প্রতিশোধের ভয়ের কারণে প্রায়ই বিষয়টি প্রকাশ করা হয় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা শিশুদের যৌন সহিংসতার অসংখ্য ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। দারিদ্র্যতা , শিক্ষার অভাব এবং আইনের অপর্যাপ্ত প্রয়োগের মতো কারণগুলি এই ধরনের নির্যাতনের জন্য দায়ী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের অসচেতনতা এবং সঠিক নির্দেশনার অভাব শিশুদের দূর্বল মনোভাবের সৃষ্টি করে। তদুপরি, নীরবতার ব্যাপক সংস্কৃতি এবং এই জাতীয় বিষয়গুলি ব্যক্তিগতভাবে নিষ্পত্তি করার সামাজিক প্রবণতা প্রায়ই ন্যায়বিচারকে বাধা দেয়।
আইনি কাঠামো
শিশু যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে একটি বিস্তৃত আইন রয়েছে। প্রাথমিক আইনের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত), দণ্ডবিধি, ১৮৬০, এবং শিশু আইন, ২০১৩। এই আইনগুলি শিশু যৌন নিপীড়ন মোকাবেলা করার জন্য এবং অপরাধীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আইনি সমাধান প্রদান করে।
উদাহরণস্বরূপ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, 2000 শিশুদের যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এটি বিভিন্ন ধরণের যৌন নির্যাতন এবং শোষণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, আইনের ৯ ধারায় শিশুকে ধর্ষণের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। আইনটির বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা সহ ভিকটিমদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়াও দণ্ডবিধির ৩৭৫ এবং ৩৭৬ ধারায় নাবালিকাদের ধর্ষণ সহ, কঠোর শাস্তির বিধান উল্লেখ করা আছে।। অতিরিক্তভাবে, ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তি অপ্রাপ্তবয়স্কদের সাথে জড়িত অপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। শিশু আইন, ২০১৩ শিশুদের অধিকার সুরক্ষার উপর জোর দেয় এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এর মতো আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলির সাথে সারিবদ্ধ করে, যার বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী। এই আইনটি বিভিন্ন ধরনের অপব্যবহার, শোষণ এবং শিশু সুরক্ষার জন্য একটি ব্যাপক আইনি কাঠামো গঠন করে। এই বিষয়ে সর্বশেষ এন্ট্রি হল সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০২৩, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন শোষণ এবং শিশুদের অপব্যবহারের হুমকি মোকাবেলা করে৷ এটি শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি এবং এর সাথে জড়িত থাকার মতো অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করে।
শাস্তি ও বিধান
বাংলাদেশের আইনে শিশু যৌন নির্যাতনের কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের অনুমতি দেয়। সর্বনিম্ন শাস্তি হিসেবে উল্লেখযোগ্য কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। দণ্ডবিধিতেও ধর্ষণ অপরাধের জন্য কঠোর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে, যা শিশু যৌন নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে আইনি অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে।
শিশু আইন, ২০১৩ এর অধীনে যৌন নির্যাতন এবং শোষণ সহ শিশুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের জন্য অপরাধীদের ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আইনটি শিশু-বান্ধব আদালত প্রতিষ্ঠা এবং এই জাতীয় মামলাগুলির সংবেদনশীল পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য পদ্ধতিগুলিকে বাধ্যতামূলক করে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনলাইন যৌন শোষণের অপরাধীর শাস্তি স্বরূপ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং যথেষ্ট জরিমানা হতে পারে। এই আইনি কাঠামোর লক্ষ্য নাবালকদের বিরুদ্ধে সাইবার-সম্পর্কিত যৌন অপরাধের ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলি মোকাবেলা করা।
বাস্তবায়নে করণীয়
দৃঢ় আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, এই আইনগুলির বাস্তবায়ন অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রায়ই যৌন নির্যাতনের সাথে জড়িত ব্যক্তি এবং তার পরিবার সামাজিক কলঙ্কের শিকার হয় এবং তাদের পরিবারকে ঘটনা প্রকাশ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে , দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার আইনি ব্যবস্থার প্রতি ব্যাপক অবিশ্বাস রয়েছে। অপর্যাপ্ত ফরেনসিক সুবিধা, ভিকটিম সহায়তা ও পরিসেবার অভাব, এবং অপর্যাপ্ত আন্তঃ-এজেন্সি সমন্বয় ন্যায়বিচারকে আরও বাধাগ্রস্ত করে। উপরন্তু, অনানুষ্ঠানিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা এবং সামাজিক প্রবণতা আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে।
উন্নতির জন্য ব্যবস্থা
শিশু যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য এবং শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করতে পারি। প্রথমত, পরিবার থেকে শিশুর মাঝে সচেতনতা তৈরি করা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে শিশু যৌন নিপীড়ন মামলাগুলি পরিচালনা করার জন্য আরও ভাল প্রশিক্ষিণ এবং সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে সহয়তা করা উচিৎ । বিশেষায়িত ইউনিট এবং ফরেনসিক সুবিধা স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ । দ্বিতীয়ত জনসচেতনতামূলক প্রচারণার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। পাশাপাশি স্কুল এবং সম্প্রদায়ের শিক্ষা কার্যক্রমগুলি এ বিষয়ে শিশুদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।। তৃতীয়ত, ভিকটিমকে ব্যাপক সহায়তা, সাহস দেয়া, পরিসেবা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চিকিৎসা, মনস্তাত্ত্বিক, এবং আইনি সহায়তা এবং বিষয়টি তাদের পরিবারের জন্য সহজলভ্য করা । চতুর্থত, বিচার বিভাগীয় সংস্কার করা। বিচার বিভাগের উচিত দ্রুত ও ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করে শিশু যৌন নির্যাতন মামলাগুলি ত্বরান্বিত করা।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।