বিচার ব্যবস্থায় যদি কোন অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হয় তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া জরুরী। এতে বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি নিশ্চিত হয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতায় বজলুর রহমান স্মৃতিপদক-২০২৩ প্রদান অনুষ্ঠানে শুক্রবার (২৮ জুন) তিনি কথাগুলো বলেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক সংবাদের সম্পাদক বজলুর রহমান ২০০৮ সালে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁর স্ত্রী বর্তমানে জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে এই পদক প্রবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
১৬ বছর ধরে নিয়মিতভাবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সেরা প্রতিবেদনের জন্য এ পদক দেওয়া হচ্ছে। এর আর্থিক মূল্য এক লাখ টাকা, সঙ্গে একটি ক্রেস্ট ও সনদ দেওয়া হয়।
শুক্রবার বিকেল চারটায় আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মতিয়া চৌধুরী অনুষ্ঠানে দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিলেন।
এ বছর ছাপা সংবাদপত্রের বিভাগে যৌথভাবে পদক পেয়েছেন দৈনিক ভোরের কাগজের ডেপুটি চিফ রিপোর্টার ঝর্ণা মণি এবং দ্য ডেইলি স্টারের রিপোর্টার আহমদ ইসতিয়াক। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পদক পেয়েছেন চ্যানেল আইয়ের স্টাফ রিপোর্টার লায়লা নওশীন। প্রধান বিচারপতি তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পদক প্রদান কমিটির বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তাঁর বক্তব্যে বলেন, শুরুতেই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে— মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর গণমুখী গনমাধ্যমের মধ্য দিয়ে যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার বাংলার, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টে নিহত জাতির পিতার পরিবারের সকল সদস্যকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ নির্যাতিতা নারীর স্মৃতির প্রতি জ্ঞাপন করছি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। সালাম জানাচ্ছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, স্মরণ করছি শহীদ জাতীয় চার নেতাকে।
তিনি বলেন, সচেতন ও শেকড়সন্ধানী নাগরিক মননের সার্থক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আজকের আয়োজনের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে পেরে আমি অভূতপূর্ব ভাবাবেগে উচ্ছ্বসিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ঐতিহাসিক অনুষঙ্গকে এ জাদুঘর ধারণ করে আছে, মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর চেতনার মাপকাঠিতে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঈর্ষণীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নতুন প্রজন্মের মাঝে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠের যে অসীম তৃষ্ণা এ জাদুঘর ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, তাতে করে আমরা আশাবাদী হই, সাহস পাই— পরাজিত শক্তিরা যতই ষড়যন্ত্র করুক— এ মাটির বুক থেকে মুক্তিযুদ্ধকে, বঙ্গবন্ধুকে, শহীদের রক্তবিন্দুকে মুছে ফেলা যাবেনা; মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মত প্রতিষ্ঠানগুলো অনন্তকাল আমাদের হাত ধরে থাকবে, পথ দেখিয়ে যাবে। জাতীয় গন্ডি পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমান সাফল্যের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। এ অর্জন কেবল এই প্রতিষ্ঠানের নয়, এ অর্জন পুরো বাংলাদেশের। আজ আমাকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্যে বজলুর রহমান স্মৃতিপদক প্রদানের অনন্য সম্মানে ভূষিত করায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রত্যেককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সাথে সাথে আজকের এ যথার্থ উপলক্ষে প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক বজলুর রহমানের স্মৃতির প্রতিও আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। নিখাদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর এ অমর ব্যক্তিত্ব তাঁর বহুধা বিস্তৃত কর্ম ও অবদানে আমাদের কৃতার্থ করে গেছেন; মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক পর্বগুলোতে অংশ নিয়ে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন; আজীবন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, দেশের পক্ষে কলম ধরে আমাদের মননকে শাণিত করে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ, সমকালের নির্ভুল প্রতিফলন। গণমাধ্যম আমাদের বোধ ও বুদ্ধি নির্মাণের প্রভাবক, আমাদের আনন্দ—বেদনার দিনলিপি, আমাদের সমাজচিন্তার সূত্রধর। বিখ্যাত ইঙ্গ—আইরিশ দার্শনিক এডমন্ড বার্ক গণমাধ্যমকে ‘ফোর্থ এস্টেট’ বা চতুর্থ স্তম্ভ বলে অভিহিত করেছেন, সে আমাদের সবারই জানা। একবিংশ শতকের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ যদি তথ্য হয়, গণমাধ্যম সেই সম্পদের অবিসংবাদিত আধার, এবং, ক্ষেত্রবিশেষে, সেই সম্পদের নির্মাতা। সুতরাং এ গণমাধ্যমের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে সাংবাদিরাই নিয়ত রচনা করে চলেছেন আমাদের ন্যায্যতাবোধ, ঔচিত্যবোধ; তাঁরাই গড়ে দিচ্ছেন আমাদের সামস্টিক করণীয়। অচিন্ত্যনীয় ঝুঁকির বোঝা মাথায় নিয়ে, বিত্ত, সুবিধা এমনকি ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে যে সাংবাদিকরা আমাদের তথ্য সরবরাহ করছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন উপাংশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করছেন, গণতন্ত্রকে সার্থক রূপ দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা সমাজের সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বটাই পালন করছেন; ব্যক্তিজীবনের অজস্র স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে আমাদের জন্য দিনমান পরিশ্রম করছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম মুখ্য নির্ণায়ক হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো যত গণমাধ্যম—বান্ধব হবে, ততটাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে গণতন্ত্র, ততটাই বিস্তৃতি পাবে মতপ্রকাশের অধিকার। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচাইতে অনুকরণীয় হয়ে আছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা হতে আমরা জেনেছি বঙ্গবন্ধু নিজে সংবাদপত্র বের করেছেন, নাম সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’। মুনতাসির মামুনের লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন’ গ্রন্থেও বিস্তারিত বিবরণ আছে এই বিষয়টির। আমরা আরও জেনেছি বরেণ্য সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে বঙ্গবন্ধুই রাজি করিয়েছিলেন ইত্তেফাকের সম্পাদকের পদ গ্রহণে। একটি সাক্ষাতকারে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম দেখতে চাইতেন। তিনি গঠনমূলক সমালোচনা সাদরে গ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধু চাইতেন সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করুক। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সমালোচনা যেমন তিনি গ্রহণ করতেন তেমনি তিনি চাইতেন প্রয়োজনে মালিকের সমালোচনাও যেন সাংবাদিকরা করেন। অর্থাৎ সাংবাদিকরা যেন বিক্রি না হয়ে যান। তারা যেন সরকার ও মালিকের আধিপত্যমুক্ত হন।’
তিনি বলেন, এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সাথে গণমাধ্যমের এমন নিবিড় সম্পর্কের কথা প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমেদসহ অন্যান্য সাংবাদিকদের স্মৃতিতে ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাইতো নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা আমাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক একটি সংবিধান উপহার দিয়েছেন যেখানে নাগরিকসহ সংবাদমাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কোলকাতায়, আঠারো শতকে, ব্রিটিশদের হাত ধরে। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ নাগরিক জেমস অগাস্টাস হিকি কর্তৃক প্রকাশিত বেঙ্গল গেজেট ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। এরপর ১৮১৮ সালের ২৩ মে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডের যৌথ উদ্যোগে এবং জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় “সমাচার দর্পণ” নামে একটি পত্রিকা বের হয়, যাকে প্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়। ১৮১৮ সালে দিকদর্শন নামে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় আরো একটি পত্রিকা বের হয়, যা ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িকী। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সকল পত্রিকা ছিল ইংরেজি ভাষায় মুদ্রিত এবং ইউরোপীয়দের দ্বারা সম্পাদিত বা পরিচালিত। বাঙালি নিয়ন্ত্রিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ছিল বাঙ্গাল গেজেট, যা ১৮১৮ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কর্তৃক হরচন্দ্র রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। প্রথম সাহিত্যপত্রিকা ছিলো ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর, যা ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয়। আজকের বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রথম পত্রিকা রংপুর বার্তাবহ ১৮৪৭ সালে গুরুচরণ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ঢাকা নিউজ। এটি ছিলো একটি ইংরেজি পত্রিকা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকা ছিলো ঢাকা প্রকাশ। এটি ১৮৬১ সালে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সত্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশই ছিল এসকল পত্রিকার লক্ষ্য।
তিনি বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় পরবতীর্তে অসংখ্য সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পত্রিকা ছিল কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ কর্তৃক ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত মাসিক গ্রামবার্তা প্রকাশিকা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বঙ্গদর্শন, ১৮৭৭ সালে ঠাকুরপরিবারের উদ্যোগে প্রকাশিত মাসিক ভারতী ও সাধনা, ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র হিসেবে পরিগণিত অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা— যেটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রূপরেখা তৈরিতেও আমাদের সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৯০৩ সালে সৈয়দ এমদাদ আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক সাহিত্যপত্র নবনূর, মোহাম্মদ আকরম খাঁর মাসিক মোহাম্মদী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় ছোটদের মাসিক পত্রিকা সন্দেশ এর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। বিশেষ করে, প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক সবুজপত্র বাংলা সাহিত্যে চলিতরীতির ভাষা প্রবর্তনে মূখ্য ভুমিকা পালন করে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এছাড়া মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মাসিক সওগাত, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য—পত্রিকা, মোজাম্মেল হকের মোসলেম ভারত, কবী নজরুলের নবযুগ, লাঙল ও ধূমকেতু, দীনেশচন্দ্র দাসের সম্পাদনায় বাংলা সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সেই কল্লোল পত্রিকা, সজনীকান্ত দাস কর্তৃক সম্পাদিত সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কালিকলম, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা এবং ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ কতৃর্ক প্রকাশিত শিখা, মাওলানা আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ, মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক এবং খায়রুল কবিরের দৈনিক সংবাদও দারুণ ঐতিহাসিক মূল্য ধারণ করে আছে। দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ এই দুটি পত্রিকা দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে ছিলো। তাই আমাদের সংবাদমাধ্যমের যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে তা ধরে রাখার প্রজন্ম এই প্রজন্মের সংবাদকর্মীদেরই। এ বিষয়ে আমি সকলকে যার যার অবস্থান হতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখার আহবান জানাই।
তিনি বলেন, সংবাদ সংগ্রহ এবং বিতরণ করতে গিয়ে যুগে যুগে, দেশে দেশে সাংবাদিকদের জেল—জুলুম, নিপীড়ন, নির্বাসনের শিকার হতে হয়েছে, তারপরও সাহসী মানুষগুলো পিছু হটেননি, দায়িত্ব পরিত্যাগ করেননি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে গণমাধ্যম জনগণের অধিকার আদায়ে পাশে থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশ বিদেশের সাংবাদিকরা যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনের সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, তারপর সেগুলো বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিয়েছেন, তার সুফল পাচ্ছি এখন আমরা, আর তা হলো এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল গণমাধ্যম জনগণের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো, তাদের মধ্যে আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত জয়বাংলা, আজিজুল হকের অগ্রদূত, সিকান্দার আবু জাফরের অভিযান, সামছুল আলমের স্বাধীন বাংলা, মিজানুর রহমানের সাপ্তাহিক বাংলা, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ইত্তেফাক, খায়রুল কবিরের দৈনিক সংবাদ এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তহিক পরিক্রমা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নাম। এই বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যুদ্ধ সংবাদ, সংগীত ও কবিতা, নাটক একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে, অন্যদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করতে কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল সাংবাদিক নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে আব্দুল গাফফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, কামাল লোহানী, শহীদুল্লাহ্ কায়সার প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদুল্লাহ কায়সার, শহীদ সাবের, সিরাজুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীনসহ অগণিত সাংবাদিক প্রাণ দিয়েছেন। তাঁরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। একই সাথে তাঁরা বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য রেখে গেছেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদর্শ। আমি আজকের সাংবাদিকদের আহ্বান জানাবো, তাঁরা যেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে কণ্ঠ ও কলম হাতে যুদ্ধ করা এই সাংবাদিকদের রেখে যাওয়া আদর্শ নিজেদের পেশাগত জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্ত্বপূর্ণ অঙ্গের একটি। এ বিভাগ নাগরিকের সর্বশেষ আস্থার স্থল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত গন্তব্য। গণমাধ্যমের সাথে আমাদের বিচার বিভাগের সম্পর্ক চিরকালই আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতার রঙে রঙিন হয়ে আছে। জনগণের আস্থাই বিচার বিভাগের সবচাইতে বড় সম্পদ, আর সেই আস্থা প্রতিফলিত হয় গণমাধ্যমের হাত ধরে। একই সাথে বিচার বিভাগ একটি সংবেদনশীল ক্ষেত্রও বটে। ফলে আদালত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা গণমাধ্যমের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতা প্রত্যাশা করি। কেননা একটি অপ্রকাশযোগ্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ বা তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা সমগ্র বিচার ব্যবস্থার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।
তিনি বলেন, আবার বিচার ব্যবস্থায় যদি কোন অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হয় তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া জরুরী। কেননা, এতে বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি নিশ্চিত হয়। বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করে থাকে। আদালতের ভাবমূর্তি যাতে ক্ষুন্ন না হয়, আদালতের ওপর মানুষের আস্থা যাতে সংকুচিত না হয়, অথবা বিচারাধীন মামলার কার্যক্রমে যেন প্রকাশিত সংবাদ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে এমন চিন্তা থেকেই এ সকল পরামর্শ প্রদান করা হয়।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, এছাড়াও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ঘটনায় আমরা কোর্ট ১১ ট্রায়ালের আগেই মিডিয়া ট্রায়ালের সংস্কৃতিতে উদ্বিগ্ন বোধ করছি। সুতরাং এ বিষয়ে আমি আপনাদেরকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের নিদের্শনার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এর সংশ্লিষ্ট অংশে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত—অবমাননা, মানহানি বা অপরাধসংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ—সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, গণমাধ্যম এখন আর কেবল সেই প্রাচীন মুদ্রিত কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গণমাধ্যমের প্রকার এখন নানাভাবে বিস্তৃত। টেলিভিশন, মুদ্রিত পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা বা পোর্টাল, রেডিওর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই বেশিরভাগ সংবাদ জেনে নিতে পারছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি—উদ্যোগে প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা অনেকক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। তাই এ বিষয়ে আমি সকলের সচেতনতা প্রত্যাশা করছি।
তিনি বলেন, আজ যাঁরা বজলুর রহমান স্মৃতিপদক অর্জন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি পেলেন, তাঁদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁদের এ প্রাপ্তি নিশ্চয়ই নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে, শাণিত কলমের ছোঁয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাশক্তিকে আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থাকে, সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এই পদক প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশে সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সাংবাদিকতার চর্চা প্রয়োজনীয় হয়ে থাকবে। তিনি পদক বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান।
সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, গত ১৬ বছরে একঝাঁক তরুণ সাংবাদিক ও নির্মাতার পরিশ্রমের ফলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক বজলুর রহমানে মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মতিয়া চৌধুরী স্বামীর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমুদয় অর্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে প্রদান করে এ পদক প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শংসাবচন পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য ফরিদুর রেজা সাগর ও এ এস এম সামছুল আরেফিন। সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, এই পদক প্রদান অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিবছরের কর্মসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের তথ্যকে নতুন দৃষ্টিতে দেখে তা জনগণের কাছে তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত করাই এ পুরস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সাংবাদিকতা ভবিষ্যতে আরও গভীরতা ও বিস্তৃতি লাভ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।