কক্সবাজারে বলৎকারের মামলায় একজনের ৭ বছর কারাদন্ড
কক্সবাজারের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত

কক্সবাজারে মিথ্যা মামলার দায়ে বাদীর জেল-জরিমানা

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : ভুল তথ্য দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় মামলার বাদীকে জরিমানা, আসামীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ পরিশোধে ব্যর্থতায় কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (এসিজেএম) কৌশিক আহাম্মদ খোন্দকার গত ২৮ জুলাই দুটি পৃথক মামলার রায়ে আসামীদের বেকসুর খালাস দিয়ে বাদীকে এ দন্ড প্রদান করেন।

রাষ্ট্র পক্ষে এপিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমদ আদালতে মামলা দুটি পরিচালনা করেন।

একই আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ আমির হোসাইন এ তথ্য জানিয়েছেন।

প্রথম মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমার ছড়া ইউনিয়নের মাইজপাড়ার ইউনুসখালী গ্রামের মোঃ শরিফ এর পুত্র বেলাল উদ্দিন জমি জমার বিরোধ নিয়ে প্রতিপক্ষ সংঘবদ্ধভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র সহকারে ইউনুসখালী এলাকায় হামলা করে গুরতর আহত করার মিথ্যা অভিযোগ এনে ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট মহেশখালী থানায় ৭ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন।

যার মহেশখালী থানা মামলা নম্বর : ৩৬, তারিখ : ২৯/০৮/২০১৫ ইংরেজি। জিআর মামলা নম্বর : ২৭৫/২০১৫ ইংরেজি (মহেশখালী)। মহেশখালী থানার এসআই আলমগীর হোসেন মামলাটি তদন্ত করে ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়েছেন মর্মে উল্লেখ করে আদালতে চার্জসীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন।

বিচার ও রায়

মামলাটি বিচারের জন্য ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী আদালতে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়। মামলায় বাদী বেলাল উদ্দিন ও সাক্ষীরা জবানবন্দি ও জেরায় আদালতে অসংগতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। একইভাবে কথিত আহতদের চিকিৎসা সনদের সাথে এজাহার ও সাক্ষীর বক্তব্যে কোন মিল পাওয়া যায়নি।

আসামীদের মামলায় জড়িয়ে হয়রানী করার কুমানসে মিথ্যা তথ্য উপাত্ত দিয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে আদালতের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। এ অবস্থায় বিচারক কক্সবাজারের এসিজেএম কৌশিক আহাম্মদ খোন্দকার গত ২৮ জুলাই মামলার আসামীদের বেকসুর খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।

মিথ্যা মামলার বাদী বেলাল উদ্দিন এর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ এনে প্রতারণার দায়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারায় মিস মামলা দায়ের করা হয়। যার নম্বর : মিস-০৩/২০২৪ (কক্সবাজার এসিজেএম আদালত)। মিথ্যা মামলার বাদী বেলাল উদ্দিন কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে আসামীদের হয়রানী, আদালত ও রাষ্ট্রের সময় নষ্ট ইত্যাদি বিষয়ে আদালত থেকে জবাব চাওয়া হয়। পরে মিথ্যা মামলার বাদী বেলাল উদ্দিন এর প্রদত্ত জবাব আদালতের কাছে গৃহীত হয়নি।

ভবিষ্যতে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার স্বার্থে বিচারক কৌশিক আহাম্মদ খোন্দকার ৭ জন আসামীর প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে কৌঁসুলির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ প্রদান, একইসাথে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০(৫) ধারা মতে রাষ্ট্রের অনুকূলে ট্রেজারী চালানমূলে ৩ হাজার টাকা জমা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ পরিশোধে ব্যর্থতায় বাদী বেলাল উদ্দিন এর বিরুদ্ধে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

কক্সবাজার এসিজেএম আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ আমির হোসাইন জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মিথ্যা মামলার বাদী বেলাল উদ্দিন সকল অর্থ পরিশোধ করায় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিস মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়।

এ মামলায় খালাস পাওয়া আসামীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন চৌধুরী।

দ্বিতীয় মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

অনুরূপভাবে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের পশ্চিম হরিয়ারছড়ার মৃত নুর আহমদ এর পুত্র ছিদ্দিক আহমদ মেম্বার জমি জমার বিরোধ নিয়ে প্রতিপক্ষ সংঘবদ্ধভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র সহকারে হরিয়ারছড়ার এলাকায় হামলা করে তার লোকজনকে গুরতর আহত করার মিথ্যা অভিযোগ এনে ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারী মহেশখালী থানায় ১০ জনকে আসামী করে আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

যার মহেশখালী থানা মামলা নম্বর : ০৩, তারিখ : ০২/০১/২০১৪ ইংরেজি। জিআর মামলা নম্বর : ০৩/২০১৪ ইংরেজি (মহেশখালী)। মহেশখালী থানার এসআই সুজন দত্ত মামলাটি তদন্ত করে ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়েছেন মর্মে উল্লেখ করে আদালতে চার্জসীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন।

বিচার ও রায়

মামলাটি বিচারের জন্য ২০১৬ সালের ২ মার্চ আদালতে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়। মামলায় বাদী ছিদ্দিক আহমদ মেম্বার, মেডিকেল সনদ প্রদানকারী চিকিৎসক ও সাক্ষীরা জবানবন্দি ও জেরায় আদালতে অসংগতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। একইভাবে কথিত আহতদের চিকিৎসা সনদের সাথে এজাহার ও সাক্ষীদের বক্তব্যের মধ্যে কোন মিল পাওয়া যায়নি। কথিত জখমীর এক্সরে না করে ভিন্নজনের এক্সরে এবং এক্সরে রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করে আদালতকে বিভ্রান্ত করা হয়।

থানাকে প্রভাবিত করে ভুল ও সৃজিত তথ্য দিয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়। আসামীদের হয়রানী করার কুমানসে মিথ্যা তথ্য উপাত্ত দিয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে আদালতের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। এ অবস্থায় বিচারক এসিজেএম কৌশিক আহাম্মদ খোন্দকার রায় ঘোষণা দিনে মামলার ১০ জন আসামীকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন।

মিথ্যা মামলার বাদী ছিদ্দিক আহমদ মেম্বারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ এনে প্রতারণার দায়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারায় মিস মামলা দায়ের করা হয়। যার নম্বর : মিচ-০২/২০২৪ (কক্সবাজার এসিজেএম আদালত)। মিথ্যা মামলার বাদী ছিদ্দিক আহমদ মেম্বার দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ধরে আসামীদের অহেতুক হয়রানী, আদালত ও রাষ্ট্রের সময় নষ্ট ইত্যাদি বিষয়ে আদালত থেকে জবাব চাওয়া হয়। মিথ্যা মামলার বাদী ছিদ্দিক আহমদ মেম্বারের প্রদত্ত জবাব আদালতের কাছে গৃহীত হয়নি।

ভবিষ্যতে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার লক্ষ্যে বিচারক কৌশিক আহাম্মদ খোন্দকার মামলার ১০ জন আসামীর প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে কৌঁসুলির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ প্রদান, একইসাথে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০(৫) ধারা মতে রাষ্ট্রের অনুকূলে ট্রেজারী চালানমূলে ৩ হাজার টাকা জমা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। পরিশোধ করতে ব্যর্থতায় বাদী ছিদ্দিক আহমদ মেম্বারের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

কক্সবাজার এসিজেএম আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ আমির হোসাইন জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মিথ্যা মামলার বাদী ছিদ্দিক আহমদ মেম্বার সকল অর্থ পরিশোধ করায় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিচ মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়।

এ মামলায় খালাস পাওয়া আসামীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট আবু সালাম।

রায় দুটি দৃষ্টান্তমূলক

ভুল তথ্য দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় মামলার বাদীকে জরিমানা, আসামীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় প্রদানের বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার বলেন, এ রায় ২টি দৃষ্টান্তমূলক রায়। এ রায়ে সমাজে একটা ইতিবাচক ম্যাসেজ যাবে। ভুল তথ্য দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীরা সতর্ক হবে। মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের দৌরাত্ম অনেক কমবে। সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হবেনা।

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ কক্সবাজার জেলা শাখার সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ বলেন, এ রায় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী রায়। মিথ্যা মামলা আদালতে অহেতুক মামলার জট বাড়াচ্ছে।

মিথ্যা মামলা কমলে আদালতের নিয়মিত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সহজ হবে। এ ধরনের রায়ে বিচার বিভাগের প্রতি বিচারপ্রার্থী ও আমজনতার আস্থা ও বিশ্বাস আরো বাড়বে বলে অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ মন্তব্য করেন।

রায় ২টির বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহ সাধারণ সম্পাদক (সাধারণ) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, মিথ্যা মামলা দায়েরকারীরা দেশ ও জাতির শত্রু। মিথ্যা মামলা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আদালতের স্বাভাবিক গতি ও নিয়মিত কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। যা কখনো কাম্য নয়।

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুর রশিদ মনে করেন, মিথ্যা মামলা নিয়ে কক্সবাজার এসিজেএম আদালতের ঘোষিত রায় ২টি কক্সবাজার বিচার অঙ্গনে মাইলফলক হয়ে থাকবে।