ড. মো. রাশেদ হোসাইন: আপনি হয়তো এই মূহুর্তে সিপিসি, সিআরপিসি, এভিডেন্স অ্যাক্ট, পেনাল কোড প্রভৃতি আইন বিষয়ক গতানুগতিক ধারার পাঠ্যক্রম বই পড়ছেন। কিন্তু মনে মনে খোঁজেন গতানুগতিক ধারার বাইরে একটু ভিন্ন ধাঁচের বই যা মানব জীবন, সমাজ, আইন এবং এদের পারস্পরিক সম্পর্ক/প্রভাব বিষয়ে আলোচনা করে কিংবা এমন একটি বই যা পড়লে আপনার চিন্তার জগত আরো প্রস্ফুটিত, বিকশিত ও প্রসারিত হতে পারে। বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলাম রচিত আইন বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন ”ন্যায়বিচারের অন্বেষণে” তেমনি একটি বই যা আপনার সেই তৃষ্ণা মেটাবে।
ব্যতিক্রমী এই বইটিতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আইনের প্রয়োগ ও প্রভাব সংক্রান্ত পৃথক আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলত, মানুষের বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে আইন-আদালত ও বিচারকের ভূমিকা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লেখক বইটিতে তুলে ধরেছেন। আমরা যারা বিচার সংশ্লিষ্ট রয়েছি যেমন- বিচারক, আইনজীবী, কোর্ট স্টাফ, পুলিশ প্রশাসন, কারা প্রশাসন, ডাক্তার, প্রভৃতি এই বিষয়গুলো খুব কমই সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করি বা ভেবে থাকি। বিচারকগণ আইনানুযায়ী বিচারকাজ সম্পন্ন করেই তাদের দায়িত্বে ইতি টানেন। কিন্তু লেখক একজন বিচারক হিসাবে বিচার কাজের পাশাপাশি কিভাবে অপরাধশূণ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা যায় যেখানে ন্যায়, সমতা ও মানবিক মর্যাদা প্রাধান্য পাবে এমনটি চিন্তা করে কলমের কালিতে নিপুণ বৈশিষ্ট্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
অনন্য এক শৈল্পিক প্রচ্ছদে ১৬৪ পৃষ্ঠার গাঁথুনিতে মাঝারি গড়নের বইটিকে লেখক মোট দুইটি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন। প্রথম অধ্যায়ে তিনি ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় প্রচলিত শাস্তি পদ্ধতির বিকল্প হিসাবে প্রবেশন ও প্যারোল ব্যবস্থা কার্যকর করাসহ বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সুক্ষ্ম বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছেন। অপরদিকে, দ্বিতীয় অধ্যায়ে আদালতে বিচারিক কাজ করতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীদের নিয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্বলিত কিছু ঘটনা যা বিচারক হিসাবে তিনি হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেছেন তা তুলে ধরেছেন।
একজন অভিযুক্ত কিংবা একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আমাদের সমাজ কিভাবে মূল্যায়ন করে? একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সাজা না দিয়ে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিলে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি আসামি ও তার পরিবারের ওপর ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ে কি? আসামির প্রদত্ত সাজা ভোগের পর তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনা সম্ভব কি, কিংবা তাকে কর্মক্ষম ব্যক্তিতে রুপান্তর করা সম্ভব কি? এসব প্রশ্নের উত্তর বিশদ ব্যাখ্যাসহ প্রবন্ধাকারে বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
একজন আসামিকে প্রবেশনের মাধ্যমে কিভাবে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা যায় এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায় তার আলোচনা বইটিতে পাওয়া যায়। এমনকি, প্রবেশন বণ্ডে শর্তাবলীর গুরুত্ব, অপরাধীকে গ্রেফতারের সময় অ্যারেস্ট মেমো প্রস্তুতকরণ, আসামির বিকৃত নামে মামলা রেকর্ডের নেতিবাচক দিক, হাজতির খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, অন্তর্বর্তী হাজতী পরোয়ানায় ‘তলবমতে’ লেখার কুফল, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সাক্ষী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব, মামলা জট কমাতে সুষ্ঠু ওয়ারেন্ট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, ভুয়া ওয়ারেন্টে ধৃত আসামির হয়রানি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতিকে ঢেলে সাজানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখানে লেখক যত্ন সহকারে পৃষ্ঠা বন্দি করেছেন। এছাড়াও প্রেক্ষাপট উল্লেখে বাংলাদেশ ও ভারতের প্যারোল আইনের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। এমনকি, গ্রাম বাংলার অসহায় নারীরা চেকের মামলায় কিভাবে ভিকটিম বা প্রতারিত হচ্ছেন তার বর্ণনাও বইটিতে পাওয়া যাবে।
হতদরিদ্র অক্ষরজ্ঞানহীন পারিপার্শ্বিক অবস্থার শিকার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তারা মিয়া ও ফুলমতিদের শাস্তি প্রদান না করে সংশোধনমূলক বিচার ব্যবস্থা তথা প্রবেশনের মাধ্যমে কিভাবে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন নাগরিকে রুপান্তর করা যায় তা লেখক অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
গুগলের সহায়তায় তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে আসামি সনাক্তকরণ, ধর্ষণকারীর বিচার নিশ্চিতকরণ, ভিকটিমের ক্ষতিপূরণের ব্যব্স্থাসহ হত্যাকারীর বিচার ও পক্ষদের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে বিচারক হিসাবে লেখকের ভূমিকা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করায় তা অন্য বিচারকের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ‘A lean compromise is better than a fat lawsuit’ ব্রিটিশ কবি George Herbert এর উক্তি সহ অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের জন্য খসড়া আইন করে Crime Victims Compensation Fund নামক ক্ষতিপূরণ তহবিল তৈরির প্রস্তাবের বিষয়টিও লেখক গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন।
আদালত কোনো সাক্ষীকে তলব করলে তিনি সাক্ষ্য দিতে বাধ্য অন্যথায় আইনে সাজার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো সরকারিভাবে যাতায়াত খরচের ব্যবস্থা না থাকায় এবং নিজের অর্থ, সময় নষ্ট হওয়ায় কিছু মামলায় বিশেষ করে মাদক মামলায় এসব অশিক্ষিত বা কমশিক্ষিত বেসরকারী সাক্ষীদের উভয় সংকটে পড়তে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাক্ষীদের যাতায়াতের জন্য ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও ২০০৭ সালের পর তথা ম্যাজিস্ট্রেসি পৃথকীকরণের পর আমাদের দেশে এই খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় না যা লেখকের লেখায় সুস্পষ্টভাবে ওঠে এসেছে।
একজন মহিলা বিচারপ্রার্থীকে আমাদের সমাজ কিভাবে দেখে, বিচার পাওয়ার জন্য তাকে কিভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করতে হয় তা এই বইয়ের ২য় অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। আবার, জেলা কারাগারগুলো অলিখিতভাবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় মাদক সেবনকারীরা মাদক ব্যবসায়ীতে রুপান্তর হচ্ছে, ফলে প্রতিটি জেলায় সরকারিভাবে মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্বও বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। পিকে হালদাররা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিদেশে আয়েশি জীবন যাপন করছে আর নিরক্ষর দিনমজুর দফিজরা দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইন মেনে চলছে -এই বিষয়টিও লেখক বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বিচারকের ভূমিকার কারণে মিথ্যা মামলায় বলি হওয়া একজন শিক্ষিত যুবককে কিভাবে মানব সম্পদে পরিণত করা যায় তার বর্ণনাও এই বইয়ে পাওয়া যাবে। বর্ণনা পাওয়া যায় সাদুদের মতো হিজরাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সন্ধান, তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন, প্রত্যয় ও শক্তি। এছাড়াও, লেখক তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন পরিসংখ্যান সহ বিদেশের তুলনামূলক তথ্য সংযোজন করেছেন।
পরিশেষে, “ন্যায়বিচারের অন্বেষণে” বইটি আইনের পাঠক তথা, বিজ্ঞ বিচারক, বিজ্ঞ আইনজীবী, আইনের শিক্ষক ও ছাত্র, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, কারা কর্তৃপক্ষ, প্রবেশন কর্মকর্তাদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় ও পাঠ উপযোগী বই। বহুল আলোচিত লেখকের অপর একটি বই “প্রবেশন ও প্যারোল আইন: তত্ত্ব ও প্রয়োগ পদ্ধতি” র মতো এই বইটিও পাঠক সমাজে প্রশংসিত ও সমাদৃত হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এমন ব্যতিক্রমধর্মী লেখার মাধ্যমে লেখক দেশ ও জাতির উন্নয়নে/কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখে আমাদের আরো এমন বই উপহার দিবেন- এমনই প্রত্যাশা করি। বইটি প্রকাশ করেছে Lexcellence (লেক্সিলেন্স) এবং প্রচ্ছদ মূল্য ৪০০ টাকা মাত্র।
লেখক: সিনিয়র সহকারী জজ, দিনাজপুর।