মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব : বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার এবং আইনী বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যাতে তার জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ না জানিয়ে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। একই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত ২৪ ঘন্টার বেশি প্রহরায় আটক রাখা যাবে না। পরিতাপের বিষয় যে সংবিধান প্রদত্ত উল্লেখিত মৌলিক অধিকার হরহামেশাই লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, দিনের পর দিন পুলিশ হেফাজতে আটক রাখা, রিমান্ডের নামে অমানবিক ও বর্বর নির্যাতন এখন নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফোজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৫৪ ধারার বিধান অনুসারে পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই-
ক. কোন আমলযোগ্য অপরাধের সাথে জড়িত বা কারো বিরুদ্ধে আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে বা যুক্তিসংগত সন্দেহ রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি;
খ. আইনসংগত কারণ ব্যতিত ঘর ভাঙ্গার কোনো সরঞ্জাম বহনকারী ব্যক্তি;
গ. আইন অনুযায়ী অপরাধী ঘোষিত ব্যক্তি;
ঘ. চোরাই মাল বহন বা সন্দেহ করা হচ্ছে এরূপ চোরাই মাল সম্পর্কিত কোন অপরাধী ব্যক্তি;
ঙ. পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব পালনে বাধা দানকারী ব্যক্তি অথবা আইনসঙ্গত হেফাজত হতে পালিয়েছে বা পালানোর চেষ্টা করেছে এমন ব্যক্তি;
চ. বাংলাদেশের কোনো সশস্ত্র বাহিনী থেকে পালিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এমন ব্যক্তি;
ছ. অন্য কোন পুলিশ অফিসারের নিকট থেকে গ্রেফতারের জন্য অনুরোধকৃত ব্যক্তি (তবে অনুরোধপত্রে গ্রেফতারের কারণ বা আনীত অভিযোগ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে);
জ. যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ বাংলাদেশের বাইরে করেছে যা বাংলাদেশে করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হত;
ঝ. কোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে মুক্তির পর তার বাসস্থান পরিবর্তন বা বাসস্থানে অনুপস্থিতি সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন;
এ নয় শ্রেণীর মানুষকে গ্রেফতার করতে পারে।
এছাড়াও এখতিয়ারাধীন এলাকায় এসে গুরুত্বর অপরাধ করার জন্য আত্মগোপনকারী, ভরণপোষণের জন্য প্রকাশ্য কোন জীবিকা নেই ও চোর বা ডাকাত হিসেবে পরিচিত কোন ব্যক্তিকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৫ ধারায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যুক্তিসংগতভাবে সন্দেহ হলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে বা অন্যকে গ্রেফতারের আদেশ দিতে পারে। পাশাপাশি ১৫০, ১৫২ ও ১৫৫ ধারায় পুলিশের বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা রয়েছে। পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এবং বিভিন্ন মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ এর ১০০ ধারা অনুসারে কোন ব্যক্তি এই অধ্যাদেশে বা অন্য কোন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে অথবা অপরাধ প্রতীয়মান হলে পুলিশ তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। অন্যান্য মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশগুলোতেও একই রকম বিধানের উল্লেখ রয়েছে।
আইন অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদেশ ছাড়া ২৪ ঘন্টার বেশী আটক রাখার বিধান নেই। তবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারার বিধান মতে, যদি প্রাপ্ত অভিযোগ বা সংবাদ যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর নিজ বিবেচনায় আসামীকে বিভিন্ন সময়ে হেফাজতে আটক রাখার ক্ষমতা প্রদান করবেন, তবে তা সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশী হবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তদন্তের স্বার্থে ২৪ ঘন্টার অতিরিক্ত পুলিশ হেফাজতে আটক রাখার বিষয়কে সাধারণভাবে ‘রিমান্ড’ বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, প্রচলিত আইনে রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। ফৌজদারী কার্যবিধিরর ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরেিদ্ধ আনীত অভিযোগ যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ফেরত তার বরাবর পাঠানোর আবেদন করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলেই রিমান্ডে আবেদন মঞ্জুর করে পুলিশের নিকট আসামিকে ফেরত দিতে পারেন তবে তা একসঙ্গে ১৫ দিনের বেশি হবে না।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রীট মামলা দায়ের করে । মামলার চূড়ান্ত শুনানী শেষে ১৫ দফা নির্দেশনাসহ রায় প্রদান করেন মহামান্য আদালত।
এ নির্দেশনাগুলো হলো-
১. বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশন দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে না;
২. কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ কর্মকর্তাকে পরিচয় প্রদান করতে হবে;
৩. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় আনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা দ্রæত গ্রেফতারের কারণসমূহ যেমন আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য, অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ, যে পরিস্থিতিতে গ্রেফতার করা হয়েছে, তথ্যের উৎস এবং তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণ ইত্যাদি কেস ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করতে হবে;
৪. যদি গ্রেফতারের সময় পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তাহলে আঘাতের কারণ লিপিবদ্ধ করা, চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতাল নেওয়া ও চিকিৎসকের সনদ গ্রহণ করতে হবে;
৫. থানায় আনার তিন ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে;
৬. বাসস্থান বা কর্মস্থল ছাড়া অন্য কোন স্থান থেকে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে, এক ঘন্টার মধ্যে আত্মীয়-স্বজনকে টেলিফোনে বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত গ্রেফতারের বিষয়টি জানাতে হবে;
৭. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পছন্দমত আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দিতে হবে;
৮. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারলে কেনো তদন্ত শেষ করা যায়নি তার কারণ এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্য কেনো সঠিক তার বিবরণসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করতে হবে;
৯. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে বর্ণিত কারণসমূহ বিবেচনা করে ম্যাজিস্ট্রেট যদি সন্তুষ্ট হন তাহলে তিনি গ্রেফতারকৃতকে কারাগারে আটকের নির্দেশ দিবেন। অন্যথায় তাকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিতে হবে;
১০. যদি গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে বর্ণিত কারণসমূহ সুদৃঢ় না হয় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করবেন;
১১. জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন;
১২. যদি তদন্তকারী কর্মকর্তা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করে এবং ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে তিনি কারণ লিপিবদ্ধ করে সর্বোচ্চ তিন দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে দেওয়ার অনুমোদন দিতে পারবেন;
১৩. জিঙ্গাসাবাদের পূর্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে মেডিকেল বোর্ড দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে তৎক্ষনাৎ পূর্বের মেডিকেল বোর্ডের কাছে পরীক্ষার জন্য নির্দেশ দিবেন। নির্যাতনের প্রমান পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট, হেফাজতে আটককৃত ব্যক্তি কর্তৃক অভিযোগের দরখাস্ত ছাড়াই, সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিবেন;
১৪. যদি থানা বা পুলিশ হেফাজত বা জেলখানায় আটক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তবে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তদন্তকারী কর্মকর্তা বা জেলার কর্তৃক মৃত্যুর খবর নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে; এবং ১৫. ম্যাজিস্ট্রেট কোন ধরনের অস্ত্রে বা কিভাবে শরীরে ক্ষত হয়েছে তা উল্লেখ করে মৃত্যুর কারণের প্রতিবেদন তৈরী ও মৃত ব্যক্তির ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
সাইফুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য মামলায় হাইকোর্ট গ্রেফতার ও রিমান্ড সম্পর্কে আরো কতিপয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে- পুলিশ কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর তাৎক্ষনিকভাবে গ্রেফতারের একটি মেমো তৈরী করা; নিকট আত্মীয়কে দ্রুত সম্ভব (কোনক্রমেই ৬ ঘন্টার অধিক নয়) গ্রেফতারের সময়, স্থান এবং বর্তমানে কোথায় আছে তা জানানো; গ্রেফতারের কারণ, তথ্য প্রদানকারী বা অভিযোগকারীর পরিচয়, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি অবস্থান লিপিবদ্ধকরণ; রিমান্ড শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা; গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আটক রাখার অত্যাবশ্যকীয় শর্ত তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু থাকা।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা পরও বিনা পরোয়ানার গ্রেফতারের ঘটনা প্রয়শই ঘটছে। কৌশল হিসেবে অন্যকোন আইন বা চলমান মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় যা shown arrest নামে পরিচিত যা অগ্রহণযোগ্য। সংবিধান, প্রচলিত আইন ও আদালতের নির্দেশনা অনুসারে প্রৃকত অপরাধীকে আইনের আশ্রয়ে নিয়ে উপযুক্ত বিচার করা হবে যা প্রত্যেক নাগরিকের প্রত্যাশা । কেননা সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার যথাযথ রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
লেখক: মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, এডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা। ইমেইলঃ ghalib.advocate@gmail.com