মোঃ নূরুল হক: বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ডিপার্টমেন্ট ‘রেজিস্ট্রেশন বিভাগ’। ১৭৯৩ সালের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তনের পর থেকে বিভিন্ন চড়াই উতরাই পার হয়ে এ বিভাগের আজকের বর্তমান অবস্থান। সম্প্রতি ‘নিবন্ধন পরিদপ্তর’, ‘নিবন্ধন অধিদপ্তর’ এ রূপান্তরিত হয়। এটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘আইন ও বিচার বিভাগ’ এর অধীন।
বর্তমানে সারাদেশে ৪৯৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস আছে। এর দপ্তর প্রধান হিসেবে আছেন সাব-রেজিস্ট্রারগণ। ১৯৯৭ সালে এ পদ প্রথম শ্রেণির গেজেটভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত রেজিস্ট্রেশন বিভাগ। এনবিআরের পরেই এর অবস্থান। সর্বশেষ অর্থ বছরে (২০২৩-২০২৪) এ বিভাগের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আদায় হয় ১৫০০৪ কোটি ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৮৪৯ টাকা (সূত্র: ওয়েবসাইট)। আর এনবিআরের মাধ্যমে এ অর্থ বছরে আদায় হয় সব মিলিয়ে তিন লাখ ৭১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা(সূত্রঃ ওয়েবসাইট)। রাজস্ব খাতের এত বড় বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও পরতে পরতে রয়েছে এ বিভাগের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা।
যাহোক, ৩৫তম বিসিএস এর মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নন-ক্যাডারে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে প্রায় ৮ মাস কর্মরত ছিলাম। ক্ষুদ্র সময়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এ বিভাগের কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। উপজেলা পর্যায়ে অন্যতম ব্যস্ত অফিস সাব-রেজিস্ট্রার এর কার্যালয়। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি কোন না কোন অফিসের আওতাধীন। মাটি ও রাজস্ব নিয়ে কাজ করে আরো কিছু বিভাগ। জমি রেজিস্ট্রি করা হয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে, নামজারি করা হয় এসি(ল্যান্ড) অফিসে আর তার আগে-পরে খাজনা দেয়া হয় তহসিল অফিসে (বর্তমানে ইউনিয়ন/উপজেলা ভূমি অফিস)।
এর মধ্যে প্রথমটি আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন, দ্বিতীয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও এসি (ল্যান্ড) হিসেবে কর্মকর্তারা প্রেষণে আসেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আর শেষেরটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিস। এ ত্রিমুখী দৌরাত্ম্যের যাঁতাকলে ভূমি ও রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম গড়াগড়ি করে। কোন কোন সাব-রেজিস্ট্রার এর কার্যালয় ঘিরে গড়ে উঠে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট।
প্রতি মাসে মাশোয়ারা আদায়ের জন্য কোটা ধার্য করা হয়। কিছু কিছু নাম সর্বস্ব সাংবাদিক ঘুর ঘুর করে অফিসের আশেপাশে। প্রায়ই সময় নামি বেনামি পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদা দাবি করে সরকারি এ অফিস থেকে। দলিল লেখকদের শক্ত সিন্ডিকেট কাজ করে এসব অফিস ঘিরে। তাঁদের আবার রাজনৈতিক পরিচয় আছে কোন কোন জায়গায়। তাঁদের হাত অনেক লম্বা।
মাঝেমাঝে তাঁদের মর্জিমাফিক দলিল রেজিস্ট্রি না হলে কলম বিরতি, অফিস ঘেরাও কর্মসূচি দিতে দেখা যায় কোথাও কোথাও। যেখানে রুটি রোজগারের ব্যবস্থা সেখানে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে এতটুকু দ্বিধা করেন না দলিল লেখকরা। ফলে সাব-রেজিস্ট্রারগণ সবসময় তটস্থ থাকেন তাঁদের ভয়ে। মোটা দাগে সাব-রেজিস্ট্রারদের কাজ হলো প্রশাসনিক, কিছুটা বিচারিক ও রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত।
কোন অফিসারই বর্তমানে খাস জমি রেজিস্ট্রি, শ্রেণি পরিবর্তন, ব্যাকডেটেড দলিল তৈরি ও মূল্যমান কমিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করেন না বলে জানা যায়। তারপরও কখনো কখনো ভুলে বা অফিসারের যোগাসাজশে এসব দলিল হয়ে গেলে আইনগতভাবে প্রসিডিং ফেস করতে দেখা যায় অফিসারদের। স্বাধীনতার এত বছর পার হলেও নকলনবিশদের এখনো স্থায়ী করা হয়নি। তাঁরা দৈনিক কাজমাফিক মজুরিতে মূল দলিল বালামে তোলা কিংবা বালাম থেকে সার্টিফাইড কপির জন্য নকল করার কাজ করে থাকেন। কিন্তু বছরের পর বছর তাঁদের মজুরি বেতন আটকে থাকে।
সরকারিভাবে বেতন ছাড় করা হয় কয়েক বছর পর পর। তাঁদের পরিবার চলে কিভাবে? অফিসে যাদের আবশ্যিকভাবে দরকার, যাদের দিয়ে কাজ করানো হয়, তাঁদের নাই কোন জব সিকিউরিটি কিংবা নিয়মিত বেতন। কার স্বার্থে এরকম হ-য-ব-র-ল অবস্থা? দু’শত বছরের পুরাতন প্রতিষ্ঠানে কেন শৃঙ্খলা ফেরানো হয়নি? এর দায়ভার কার? তাছাড়া উপরি মহলের নিয়মিত মাশোয়ারা আদায় তা তো রীতিমত ওপেন সিক্রেট হয়ে আছে।
নিশ্চয়ই সিস্টেমে গ্যাপ মানে কারো কারো লাভ! ইচ্ছে করেই নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছে এসব অফিসে। তাছাড়া কোথাও কোথাও ওমেদার, নৈশ প্রহরী কাজ করলেও স্থায়ীভাবে এসব কর্মচারী থাকেন না। অফিস খরচ তো আছেই। নানা অজুহাতে সিস্টেম ডাউন করা আছে এখানে। কেন এখনো শুনতে হবে টিসি মোহরার ডিসি অফিস থেকে বেতন পান? কোন কোন জায়গায় তো অবকাঠামো ও স্টাফ সংকট তীব্রভাবে প্রকট। সংস্কার ও সমাধানের কোন উদ্যোগ নাই।
আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও দৃশ্যত এটি অবস্থার উন্নয়নে গার্ডিয়ানসূলভ তেমন কোন ভূমিকা রাখছে না মর্মে ক্ষোভ দেখা যায়। এখনো পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে ‘রেজিস্ট্রেশন বিভাগ’ নামে কোন বিভাগ বা শাখা নাই। মোট কথা রেজিস্ট্রেশন বিভাগের অসংগতির কোন শেষ নাই। এতকিছুর পরও আশার বাণী হলো নবীন অফিসারদের দাবি একটা স্মার্ট ও ডিজিটালাইজ্ড অফিস হবে সাব-রেজিস্ট্রার এর কার্যালয়।
ইতোমধ্যে কিছু অফিসার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও ডিজিটাল আর্কাইভ সহজীকরণ এ্যাপস্ তৈরি করেছেন বলে শোনা যায়। যা সরকার ইতোমধ্যে আত্মীকরণ করেছেন এবং কোন কোন জায়গায় পাইলট প্রকল্প আকারে চালু করা হয়েছে। অথচ এরকম একটা উদ্যোগের জন্য প্রজেক্ট বা প্রকল্পের নামে শত শত কিংবা হাজার কোটি টাকার সরকারি খরচেরও খবর শোনা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। তাই সময়ের সাথে দাবি উঠেছে এ বিভাগকে ঢেলে সাজানোর।
কিছু সংস্কার প্রস্তাব এ বিভাগের প্রাণের দাবি এখন। ইতোমধ্যে ১১ দফা ঘোষণা করা হয়েছে। যা হোক, আমার মতে পুরো সিস্টেমকে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিকীকরণ করতে করতে হলে কিছু পরিবর্তন অবশ্যই আনতে হবে। যেমন-
১. ‘ভূমি ও রেজিস্ট্রেশন’ নামে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস অনতিবিলম্বে চালু করতে হবে। যা হবে পৃথক মন্ত্রণালয় ‘ভূমি ও রেজিস্ট্রেশন মন্ত্রণালয়’ এর অধীন।
২. এর দুটি বিভাগ থাকবে- ক) ভূমি বিভাগ ও খ) রেজিস্ট্রেশন বিভাগ।
৩. ভূমি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত থাকবে-জরিপ, খতিয়ান, পর্চা, খাজনা, রাজস্ব, নামজারি ইত্যাদি সকল বিষয় যা বর্তমানে এসি(ল্যান্ড) অফিস, এডিসি(রেভিনিউ) অফিস ও উপজেলা/ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অন্তর্ভুক্ত সকল কার্যক্রম।
৪. রেজিস্ট্রেশন বিভাগে থাকবে বর্তমান রেজিস্ট্রেশন বিভাগের সকল কার্যক্রম।
৫. উভয় বিভাগে দপ্তর প্রধান হিসেবে থাকবেন ‘ভুমি ও রেজিস্ট্রেশন ক্যাডার’গণ। কোন ডেপুটেশন কর্মকর্তা থাকবেন না। নিজস্ব ও স্বতন্ত্র ক্যাডারগণ থাকবেন কেবল।
৬. নিজস্ব আইজিআর ভবন থাকবে। সারাদেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও স্টাফ সংকট দূর করতে হবে।
৭. ভূমি ও রেজিস্ট্রেশন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি বিভাগ ও রেজিস্ট্রেশন বিভাগের জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে সমন্বয় রেখে প্রয়োজনীয় জনবলের নতুন অর্গানোগ্রাম তৈরি করতে হবে।
৮. নকলনবিশদের স্থায়ীকরণ করতে হবে। গ্রেডভিত্তিক অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
৯. অন্যান্য স্টাফদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ ও যথাসময়ে প্রমোশন নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করতে হবে। নতুন দলিল রেজিস্ট্রির সাথে সাথে তা ডিজিটাল আর্কাইভে জমা করতে হবে। প্রত্যেক অফিসে এজন্য সিস্টেম এনালিস্ট পদ সৃজন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কিংবা একটি করে আইটি কর্নার স্থাপন করতে হবে। সার্টিফাইড কপি সরাসরি উক্ত আর্কাইভ থেকে প্রিন্ট বের করে বিদ্যমান আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ করে দেওয়া যাবে।
১১. প্রতিদিনের দলিল রেজিস্ট্রির পরিসংখ্যান এবং মাসিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন অনলাইনে এন্ট্রি দিতে হবে। এজন্য জাতীয়ভাবে ও কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থাকবে। প্রতি অফিস থেকে ইনপুট দেয়ার সুযোগ থাকবে।
১২. দলিল রেজিস্ট্রির সাথে সাথে নামজারি কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছে যাবে বিদ্যমান এলটি নোটিশ প্রেরণের আদলে। পরবর্তীতে আইন নির্ধারিত ফি ও পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক তা সম্পন্ন হবে।
১৩. ডিসিআর ও খাজনার দাখিলা অনলাইনভিত্তিক হবে। সফটওয়ার এর মাধ্যমে তা অটো জেনারেটেড করতে হবে। পুরাতনগুলোর অনলাইন কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দিষ্ট সময় পর তা অকার্যকর ঘোষণা করতে হবে।
১৪. সকল প্রকার খতিয়ানের চলমান ডিজিটালাইজ্ড কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে। এখন থেকে নামজারি পরবর্তী সকল কার্যক্রম ডিজিটালাইজ্ড হবে।
১৫. সকল প্রকার নকল তোলা অনলাইন থেকে প্রিন্ট কপি হবে। এরিমধ্যে পুরাতনগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডিজিটালাইজ্ড এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
১৬. মৌজা ভিত্তিক সর্বনিম্ন বাজার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি আরো যুগোপযোগী করতে হবে। যাতে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া বন্ধ হয়।
১৭. স্থানীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
১৮. দলিল লেখকদের আরো আধুনিকায়নের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কমিশন বা কাউন্সিল করে পরীক্ষার মাধ্যমে লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন পদ্ধতির ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯. সরকারি অফিস থেকে নামে বেনামে সকল প্রকার চাঁদা উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
২০. ভূমি ও রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত সকল আইন যুগোপযোগী ও আরো সহজীকরণ করতে হবে।
২১. এনআইডি/জন্ম নিবন্ধন সনদ/পাসপোর্ট, দলিল, নামজারি, খতিয়ান, ডিসিআর, খাজনার দাখিলা ইত্যাদি সকল কার্যক্রমে অভিন্ন নাম ও তথ্য এবং অনলাইনভিত্তিক যোগসূত্র/ডাটাবেজ নিশ্চিত করতে হবে।
২২. সকল প্রকার টাউট ও সিন্ডিকেট মুক্ত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
২৩. কেন্দ্রীয়ভাবে স্থাপিত মনিটরিং সেলের মাধ্যমে বার্ষিক অডিট ও দপ্তরের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় তদারকি করতে হবে।
২৪. দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
২৫. কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নিয়োগ,পদায়ন, পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, ইত্যাদি সংক্রান্ত স্বতন্ত্র নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
লেখক: মোঃ নূরুল হক; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।