১. বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গুম বিরোধী সনদ International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance এ স্বাক্ষর করেছে। তার আগে গুমের প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত উদঘাটন ও ভবিষ্যতে প্রতিরোধের জন্য সুপারিশ করতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এর নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিসন গঠন করেছে। কমিসনকে ২০১০ এর শুরু হতে ৫ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত প্রতিটি গুমের ঘটনা তদন্ত করতে বলা হয়েছে। হিউম্যান রাইট ওয়াচ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ৬০০ এর বেশী গুমের ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।
২. জাতিসংঘের গুম বিরোধী এ সনদটি ২০০৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় এবং প্রয়োজনীয় সমর্থন পেয়ে ২০১০ হতে কার্যকারিতা পায়। বাংলাদেশ এতদিন এ সনদ স্বাক্ষর করেনি। গতকাল ২৯ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস সনদটিতে স্বাক্ষর (Accession) করেন। বাংলাদেশের এ উদ্যোগ আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ২৫ এ উল্লেখিত আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি জোড়ালো সমর্থন ব্যক্ত করে।
৩. এর ফলে সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে প্রতিটি গুমের ঘটনার বিচার করতে হবে। তার আগে গুমকে সুনির্দিষ্ট ভাবে দেশীয় আইনে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। যুদ্ধ বা কোন অজুহাতে গুমকে জায়েজ করা যাবে না। ভিকটিমদের নিরাপত্তা দিতে হবে, ক্ষতিপূরণে ব্যবস্থা করতে হবে। যারা অভিযুক্ত তাদের নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার এর নিশ্চয়তা দিতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো অপরাধের তদন্ত ও বিচারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে পারবে, আসামিকে এক দেশ হতে অন্য দেশে বহিঃসমর্পণ (Extradition) করতে পারবে।
৪. আর্টিকেল ২ এ গুমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব, সমর্থন বা নিরবতা নিয়ে রাষ্ট্রের কোন এজেন্ট বা সমর্থিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক কোন ব্যক্তিকে আটক, গ্রেপ্তার, অপহরণ বা অন্য কোন ভাবে স্বাধীনতা বঞ্চিত করা এবং পরবর্তীতে তা অস্বীকার করা বা তার খোঁজ না দেয়া। গুমের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের কথা এ সনদে বলা আছে। এ সনদে আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে তা হলো সুপারিয়র রেসপন্সিবিলিটি নির্ধারণ। যার অধিনস্তদের দ্বারা গুমের ঘটনা ঘটেছে, তা জানা থাকা অথবা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারাও সুপারিয়র রেসপন্সিবিলিটির অপরাধ। সনদটিতে Substantial এবং Procedural মিলে মোট ৪৪ টি আর্টিক্যাল আছে।
৫. আমাদের আইনে গুমের কোন সংজ্ঞা নেই। তবে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করার ম্যাকানিজম কম বেশী আগে হতে ছিল। আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে আটককৃত ব্যক্তির অধিকার বিষয়ে বলা আছে। তাকে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে। আইনজীবীর সাথে পরামর্শের সুযোগ দিতে হবে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে উপস্থিত করতে হবে। এমনকি ১৮৯৮ সালের যে ফৌজদারি কার্যবিধি, তার ৬১ ধারায় বলা আছে, সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টার বেশী কাউকে আটক রাখা যাবে না। এসব বিধান থাকলেও সেগুলো যে সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়নি তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশে এরেস্ট স্বচ্ছ প্রক্রিয়া মেনে করা হয় না। গ্রেপ্তারের অনেক পর আসামীকে আটক দেখানোর অনেক নজীর রয়েছে। গুমের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি গুমের ঘটনায় আটক বা গ্রেপ্তার সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গুমের ঘটনায় ভিকটিমরা জিডি করেছে, ভিকটিমের খোঁজ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়েছে। এমনকি সংবাদ সম্মেলন করলেও কেউ আটক বা গ্রেপ্তার এর কথা স্বীকার করেনি।
৬. নিয়মতান্ত্রিক ভাবে আইন মেনে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে- এটা স্বীকার করলে গুম করা সম্ভব ছিল না। আর গুমের ঘটনার শর্তই হলো আটক, গ্রেপ্তার অস্বীকার করা বা ভিকটিমের অবস্থান গোপন করা। ত্রুটিপূর্ণ আটক বা গ্রেপ্তার এর যে পদ্ধতি রয়েছে তা আরও স্বচ্ছ ও সুন্দর (fair & transparent) করতে আমাদের এপেক্স কোর্ট এর চমৎকার রায় আছে। Precedent হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতের এসব রায় আইনের মর্যাদা পায়। State Vs Blast & others [8 SCOB (AD) 1] মামলায় আপীল বিভাগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। একই সাথে এ মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট ও জাজদের প্রতিও নির্দেশনা রয়েছে। গ্রেপ্তার বা আটকে ভিকটিমকে হত্যা বা নির্যাতন করলে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন- ২০১৩’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এই রায়ে গুরত্বপূর্ণ যেটা বলা আছে তা হলো Memo of Arrest তৈরী। একটি ফর্মে কখন, কোথায়, কার সামনে এরেস্ট উল্লেখ থাকতে হবে। আত্মীয় স্বজনের সামনে না হলে আটকের বিষয় ১২ ঘন্টার মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে জানানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক গ্রেপ্তারে মেমো অফ এ্যরেস্ট তৈরীর এ নির্দেশনা সারাদেশে একই ভাবে প্রতিপালিত হয় নাই; হলে কোন এরেস্ট বা আটক অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকতো না; স্বীকার করলে গুমও হতো না।
৭. গুম চরম নির্মম ও নিষ্ঠুর একটা অপরাধ। এ ক্ষেত্রে ভিকটিমের জীবন, চিন্তা, চলাফেরা সহ সব ধরণের অধিকার অস্বীকার করা হয়। আমাদের গুম প্রতিরোধের পাশাপাশি ক্রসফায়ারও পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, প্রতিটি অপরাধের বিচার করতে হবে আইনগত পদ্ধতি (Due process of law) মেনে। সে জন্য বিচার বিভাগকেও কার্যকর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
আর কেউ গুমের মতো নির্মমতার শিকার না হোক, আর কোন ক্রসফায়ার না ঘটুক, সবাই আইনানুসারে ব্যবহার পাক- আন্তর্জাতিক গুম বিরোধী দিবসে (৩০ আগস্ট) এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: মোঃ জিয়াউর রহমান, এমফিল ফেলো, ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ।