মোঃ জিয়াউর রহমান: জামিন এ শর্তারোপের উদাহরণ আছে; তবে সে শর্ত কতটুকু পর্যন্ত আরোপ করা হলে ব্যক্তির জীবনের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, গোপনীয়তার অধিকার লংঘন হয় বা হয় না- তা নিয়ে লিগ্যাল স্কলারদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।
প্রযুক্তি এগিয়ে চলছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির অবস্থান সনাক্ত ও তাকে নজরদারির মধ্যে রাখতে পুলিশও হিমশিম খাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বছরগুলো ভারতীয় আইনাঙ্গনে একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে, তা হলো মাদক, ধর্ষণ সহ Heinous Nature এর ক্রাইমে অভিযুক্তের জামিনে মুক্তির ক্ষেত্রে পুলিশের মাধ্যমে অভিযুক্তের লাইভ মোবাইল লোকেশন শেয়ার করার শর্ত দেয়া হচ্ছে।
ভারতে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট- উভয় আদালত কর্তৃক এমন শর্তারোপ নিয়ে বিতর্ক আছে। এর মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত কে সার্বক্ষনিক নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। অধিকার কর্মীদের মতে, অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পেলেও সে এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকছে যা তার মুক্তজীবন কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া ফোন চুরি বা নষ্ট হলে শর্ত ভঙ্গ হওয়ার আশংকা তৈরী হয় যার দায় অভিযুক্তের নয়।
আরেকটা ইস্যু হলো, অভিযুক্ত তো বিচারাধীন রয়েছে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত করার আগে তাকে অপরাধী ভাবার সুযোগ নেই। এ ধরনের Preemptive Punishment অভিযুক্তের অধিকার ও Presumption of innocence নামক বিচারিক মানদণ্ড কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সার্বক্ষনিক নজরদারির পক্ষেও যুক্তি আছে। এতে করে অভিযুক্তের গতিবিধি পুলিশ বা আইনশৃংখলা বাহিনী জানতে পারছে। সে যেন ভিকটিম বা সাক্ষীকে ভয় না দেখাতে না পারে বা পালিয়ে যেতে না পারে, পুলিশের পক্ষে সেটা নিশ্চিত করা সহজ হয়। আর এটা তো অভিযুক্তের বাস্তব চলাচল, জীবনযাপনকে বাঁধা দিচ্ছে না।
সার্বক্ষণিক নজরদারির ঘটনা ও বিতর্ক কিন্তু পশ্চিম হতে আমদানিকৃত। আমেরিকান বিচার ব্যবস্থায় অভিযুক্তের Electronic Monitoring (EM) সিস্টেমের সূচনা হয় ১৯৮৩ সনে। ২০১০ সন পর্যন্ত USA এর ৩৩ টি রাজ্য এই ব্যবস্থা অনুমোদন দেয়। ২০১৫ সালে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, জিপিএস ট্রাকিং ১৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেয়া অভিযুক্তের অধিকার ক্ষুন্ন করছে কি না তা আদালত যাচাই করতে পারবে। এরপর আমরা দেখতে পাই, ২০১৯ সনে জর্জিয়া সুপ্রিম কোর্ট জিপিএস ট্রাকিং কে Unreasonable & Invalid ঘোষণা করে।
ইউরোপে Electronic Monitoring (EM) এর আবির্ভাব ঘটে ২০১০ সনে। ১০ বছরের সাজা ভোগ করার পরও একজন পুনঃঅপরাধীকে Preventive Detention এ রাখা হলে M v. Germany মামলায় European Court of Human Rights আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করলে জার্মানি Electronic Monitoring System এর সূচনা করে। German Federal Constitutional Court ২০১১ সালে এই সিস্টেম কে Privacy কে ক্ষুণ্ণ করে না বলে বৈধতা দেয়।
সার্বক্ষণিক নজরদারি বিষয়ে সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের Frank Vitus V. Narcotics Control Bureau মামলার রায় নিশ্চয়ই বড় ধরনের Legal Development. ফ্রাঙ্ক একজন নাইজেরিয়ান আফ্রিকান এবং তিনি মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হোন। দিল্লী হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন, তবে ২ টি শর্তারোপ করেন-
১. Google Map এর মাধ্যমে লোকেসন শেয়ার চালু রাখতে হবে,
২. তার দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে সে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যাবে না।
সুপ্রিম কোর্ট Frank Vitus মামলায় অপরাধীর জিও লোকেসন শেয়ার এর মাধ্যমে লোকেসন শেয়ার করা অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে যেহেতু এতে ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুন্ন হয়।
গুগল এ মামলায় স্বীকার করেছে, তাদের লোকেসন শেয়ারে সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্ণয় আসলে নিখুঁত নয়। সুপ্রিম কোর্ট এ মামলায় বলছে, Interest of justice এর নামে Fanciful এবং Arbitrary শর্তারোপ করা যাবে না। বন্দী হোক বা অপরাধী সাব্যস্ত হোক, একজন ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে জীবনের অধিকার সবসময় বহাল থাকে এবং তার এ অধিকার ক্ষুন্ন করে এমন কোন শর্তারোপ করা যাবে না যার মাধ্যমে কখন, কোথায় সে যাচ্ছে তা জানার মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেয়া যায়, আর এটা হলে তার মুক্তি জেলখানায় রাখার মতই একটা বিষয়।
সুপ্রিম কোর্ট বলছে, শর্তারোপ যুক্তিপূর্ণ এবং যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে দিতে হবে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এর আরেকটি লান্ডমার্ক জাজমেন্ট হলো Puttaswamy মামলা, সেখানে বলা হয়েছে, ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার অতিক্রম করতে হলে ৩ টি মানদণ্ড উত্তীর্ণ হতে হবে-
১. আইনগত বৈধতা (legality),
২. রাষ্ট্রীয় বৈধ প্রয়োজন (Legitimate State Aim) এবং
৩. আনুপাতিকতা (Proportionality).
ব্যতিক্রম হলেও আমাদের দেশেও মোবাইল ট্রাকিং এর শর্তে আসামীর জামিন দেওয়ার নজীর আছে। সেগুলো নিশ্চয় ধাপে ধাপে মাননীয় আপীল বিভাগে শুনানী ও সিদ্ধান্ত হবে। উন্নত দেশগুলোতেও বিষয়টি নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। দেখা যাক, আমাদের মাননীয় এপেক্স কোর্ট এমন Electronic Monitoring কে কতটুকো স্বীকৃতি দেয়, আর দিলেও তার পরিধি কত টুকো হয়।
লেখক: এমফিল ফেলো, ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস)।