আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট থেকে অধস্তন আদালতের কার্যক্রম শুরু হলেও ঢাকা জেলা ও মহানগরের আদালতগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় সাত শতাধিক প্রসিকিউটর দায়িত্ব পালনে আদালতে আসছেন না। ফলে সেখানে ট্রায়াল মামলাগুলোর বিচারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এই প্রসিকিউটরদের সবাই গত আওয়ামী লীগ সরকার থেকে নিয়োগ পেয়েছিলেন। খবর আমাদের সময়ের
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, প্রসিকিউটরদের বড় একটি অংশই সরকার পরিবর্তনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজ থেকেই কর্মস্থলে আসছেন না। কেউ কেউ কাজ করতে চাইলেও তাদের কাজে বাধা দিচ্ছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা।
এর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা প্রসিকিউটর নিয়োগে তালিকা তৈরি এবং নিয়োগ পেতে তদবিরে ব্যস্ত আছেন। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ আইনজীবী খোঁজায় প্রসিকিউটর নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
শতাধিক ফৌজদারি আদালতে সাত শতাধিক পাবলিক প্রসিকিউটর
ঢাকার অধস্তন আদালতে শতাধিক ফৌজদারি আদালত রয়েছে। এগুলোতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন দফায় প্রায় সাত শতাধিক পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ঢাকা জেলা জজ আদালতে এক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের একজন পাবলিক প্রসিকিউটর। তাদের অধীনে অর্ধশতাধিক অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, অর্ধশতাধিক স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর এবং বাকি ছয় শতাধিক সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়।
এই প্রসিকিউটরদের মধ্যে অনেকে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, এর অধীনস্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতগুলোতে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। অনেক প্রসিকিউটর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত, এর অধীনস্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতগুলোতে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া চারটি দ্রুত বিচার টাইব্যুনালে, ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন টাইব্যুনাল, ১০টি বিশেষ জজ আদালত, সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল, সাইবার ট্রাইব্যুনাল, জননিরাপত্তা অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল, পরিবেশ আদালত, পরিবেশ আপিল আদালতে অনেক প্রসিকিউটর দায়িত্ব পালন করেন।
এর বাইরে মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত, এর অধীনস্থ অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আদালত ও মহানগর হাকিম আদালত এবং মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালত, এর অধীনস্থ অতিরিক্ত বিচারিক হাকিম আদালত ও বিচারিক হাকিম আদালতগুলোতে প্রসিকিউটররা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।
প্রসিকিউটরদের কাজ
প্রসিকিউটরদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে আদালতে হাজির করা, আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীকে জেরা করা, প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করে জেরা করা এবং সাক্ষী না এলে আদালতে সময়ের আবেদন করা, প্রয়োজনমতো জামিন আবেদনের বিরোধিতা করা, চার্জগঠনের বিষয়ে আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ উপস্থাপন করা এবং রাষ্ট্রপক্ষে আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া এই প্রসিকিউটরদের অধিকাংশই আদালতে আসা থেকে বিরত রয়েছেন। যারা আদালতে এসেছেন, তাদের বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছেন না।
এ সম্পর্কে ফৌজদারি মামলাবিষয়ক সিনিয়র আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর একটি হত্যা মামলা সাক্ষী এলেও পাবলিক প্রসিকিউটর না থাকায় আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ করেননি।
এই আইনজীবী বলেন, একটি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্ততর্কের জন্য পাবলিক প্রসিকিউটর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সাক্ষীকে প্রস্তুত করে আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। সাক্ষীকে প্রস্তুত না করলে তিনি অনেক ভুল করতে পারেন, যা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা দুর্বল করে দিতে পারে। এতে আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারে।
যে কারণে নিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগের তালিকা তৈরি করে রেখেছেন। ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ হওয়ার পরই তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে গত ২৭ আগস্ট সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরদিন গত ২৮ আগস্ট বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা নিয়োগ বাতিল চেয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
ফলে গত ২৯ আগস্ট প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি ওই পদে যোগদান করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। এরপর প্রায় ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো ওই পদে কাউকে নিয়োগ প্রদান করা হয়নি।
এদিকে এহসানুল হক সমাজী অপারগতা প্রকাশ করার পর ওই পদে সিনিয়র ফৌজদারি আইনজীবী আমিনুল গণি টিটোকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি গ্রহণ করতে রাজি হননি।
অন্যদিকে বিএনপিদলীয় তিনজন আইনজীবী মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর পদে নিয়োগ লাভের জন্য আবেদন করেছেন মর্মে জানা গেছে। তারা হলেন- ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারুকী এবং বিএনপির সহ আইন সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদন মেজবাহ।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকার বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোনো আইনজীবীকে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর পদে নিয়োগ দিতে চাচ্ছে না। তারা নিরপেক্ষ আইনজীবী খুঁজছেন। এ কারণেই নিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে।