‘শুধু বিচারের বাণী নয়, বিচারকও নিভৃতে কাঁদে’
খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন

‘শুধু বিচারের বাণী নয়, বিচারকও নিভৃতে কাঁদে’

‘আমরা আজীবন পড়েছি এবং জেনেছি বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। কিন্তু কেউ হয়তো জানে না যে শুধু বিচারের বাণী নয়, বরং বিচারকও অনেক সময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিভৃতে কাঁদে। কারণ, বিচারকের বলার জায়গা এবং সুযোগ কোনোটাই থাকে না। ধারণা করা হয়, বিচারকের মুখ বন্ধ থাকবে। কান দিয়ে শুনবে এবং হাত দিয়ে লিখবে। আমাদের অভিভাবক মহোদয়কে জানাতে চাই বিচারকেরাও অবিচারের শিকার হয়।’

অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির দেওয়া অভিভাষণ অনুষ্ঠানে শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) এসব কথা বলেন খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন।

সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে এই অভিভাষণের আয়োজন করা হয়। এ সময় সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারক ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জুলাই–আগস্টের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট বদলির নীতিমালার অভাবে অনেক বিচারক দিনের পর দিন বাড়ি থেকে শত কিলোমিটার দূরে কখনো বা দুর্গম জায়গায় মনের কষ্ট নিয়ে বিচারের মতো স্বর্গীয় কাজ করে চলেছেন। অনেক বিচারক এমন জায়গায় এজলাস–চেম্বার করেন যে ভয় হয় যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ে কোনো সংবাদ শিরোনামের কারণ না হয়! এজলাস দিয়ে পানি পড়ে, টিনশেডের এজলাসে গ্রীষ্মের ভয়াবহ দাবদাহের সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে হয়। আবার কোথাও কোথাও দুই–তিনজন মিলে ছোট্ট একটা চেম্বারে বসে। কখনো এমন হয় যে বিচারকের চেম্বার এক জায়গায়, এজলাস আরেক জায়গায়। বিচারকদের এজলাস ও চেম্বারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সময়ের দাবি।’

আরও পড়ুন: আসামিকে জামিন দেওয়ায় বিচারকের অপসারণ দাবি

তিনি বলেন, ‘মহানগর দায়রা জজ, সিএমএম ও সিজিএমের সরকারি বাসভবন প্রয়োজন। মহানগর দায়রা জজ, সিএমএম এবং সিজিএমের নিজস্ব বাংলো না থাকায় তাঁরা ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনে থাকতে বাধ্য হন। যা তাঁদের জন্য বিব্রতকর এবং অনেক সময় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া ত্বরিত করার জন্য এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগের অধীনে ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি এবং প্রসিকিউশন বিভাগ থাকা অতি জরুরি। তা না হলে অন্যের দায়ভার বিচার বিভাগকে গ্রহণ করে কলঙ্কিত হতে হয়।’

এই বিচারক আরও বলেন, অনেক সময় সেনসিটিভ মামলার বিচারকার্য করে বিচারককে হেঁটে কিংবা রিকশায় করে ঘরে ফিরতে হয়। অনেক সার্ভিসে গাড়ি সুবিধা পেলেও বিচারকের জন্য সেই দ্বার অবরুদ্ধ। বিচারকের সম্মান রক্ষার্থে গণপরিবহনে, ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্য হয়ে মামলার পক্ষদের সঙ্গে যাতায়াত করার মতো বিব্রতকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং নিরাপত্তা রক্ষার্থে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি নগদায়ন সুবিধা দাবি করেন তিনি।

এ ছাড়া আদালত চত্বরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা, বিচারকদের যেকোনো সমস্যায় যোগাযোগ রক্ষার্থে সুপ্রিম কোর্টে পৃথক ডেস্ক এবং বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল রুখতে আলাদা মিডিয়া উইং করার দাবিও জানান এই বিচারক।

নওগাঁর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মণ্ডল বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের আজন্ম লালিত একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। স্বাধীন বিচার বিভাগই পারে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে প্রতিরোধ করতে।

‘শুধু বিচারের বাণী নয়, বিচারকও নিভৃতে কাঁদে’
নওগাঁর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মণ্ডল

তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থী মানুষের দুঃখ–দুর্দশা লাঘব করতে মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগ থেকে যে ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর মাত্র কয়েকটি পরিবর্তিত আকারে বাস্তবায়িত হলেও অধিকাংশই অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন ও স্বকীয় বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার আবশ্যক।

এ সময় ১১ দফা দাবি জানান নওগাঁর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মণ্ডল। তাঁর দাবিগুলো হচ্ছে—

১. জেলা পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
২. বিভিন্ন আইনে উল্লেখিত আদালত ও ট্রাইব্যুনালগুলোর জন্য বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীর পদসহ পৃথক আদালত সৃষ্টি। দেশের জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা যুক্তিসংগত হারে বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান শূন্য পদে পদোন্নতির মাধ্যমে বিচারক নিয়োগে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব পরিহার।
৩. সব পর্যায়ের বিচারকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা সুবিধাসহ পৃথক আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
৪. জেলা আদালতগুলোতে মামলা পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস (সরকারি আইন কর্মকর্তা) প্রবর্তন এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সরকারি আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগ।
৫. দেশের মোট বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ থাকে মাত্র ০.৩ শতাংশ, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং প্রতিটি আদালতের বিপরীতে পৃথক বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।
৬. ফৌজদারি মামলার স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ তদন্ত ও কম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির স্বার্থে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত তদন্তকারী সংস্থা এবং আদালত প্রাঙ্গণ ও বিচারকদের নিরাপত্তাসহ আদালতের আদেশ কার্যকর করার জন্য বিচার বিভাগের অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠন।
৭. ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজীকরণ ও জনসাধারণের দোরগোড়ায় বিচারিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলার জন্য পৃথক পৃথক আদালত নিশ্চিত করতে হবে। নতুন উপজেলা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ একটি করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন।
৮. বিচারকদের কাজের ধরন ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সকল পর্যায়ের বিচারকদের জন্য পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করা।
৯. বিচারকদের বেতনবৈষম্য দূরীকরণে মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের নির্দেশনার আলোকে মূল বেতনের ১০০ শতাংশ হারে বিচারিক ভাতা প্রদান।
১০. বিচারকদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি।
১১. শত বছরের পুরোনো আইনগুলো বর্তমান সময়ের নিরিখে সংস্কার করে যুগোপযোগী করা।