আট মাসে মামলা হয়েছে সাড়ে ৮ লাখ, নিষ্পত্তি পাঁচ লাখ
মামলা জট

দেওয়ানী মোকদ্দমার দীর্ঘসূত্রিতার কারণ

জামাল হোসাইন : Right to life and Right to property তথা জীবন ও সম্পদের অধিকার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক মানবাধিকার এবং জীবনের জন্যে সম্পত্তি অর্জন, ধারণ ও হস্তান্তরের অধিকার প্রয়োজন। একটা মানবিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য নাগরিকের এ দুই ধরনের অধিকার সংরক্ষণ করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।

যখন উপরোক্ত অধিকার সমূহ লঙ্ঘিত হয় তখন প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি ও দেওয়ানী মামলা দায়েরের মাধ্যমে দ্রুততর সময়ে প্রার্থিত প্রতিকার পাওয়াটা ও জনগণের বৈধ প্রত্যাশা। অতীব দুঃখের বিষয় যে যখনই একটা দেওয়ানী মামলা করা হয় তখন সেটা আর শেষ হতে চায় না, এক পর্যায়ে বিচারপ্রার্থী হতাশ হয়ে যায় এবং প্রার্থিত প্রতিকার পেতে এক দুই প্রজন্ম পৃথিবী থেকে চলে যায়।

আজকের নিবন্ধে সহজে ও সংক্ষেপে দেওয়ানী মোকদ্দমার (দেওয়ানী কার্যবিধি এর ৯ ধারা অনুযায়ী সম্পত্তি ও পদবী সংক্রান্ত অধিকার নিয়ে যে মোকদ্দমা) দীর্ঘসূত্রিতার কারণ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শুরু করছি। আমার পরিবারের একটা adverse possession এর মামলা ২০০৬ সাল থেকে এখনো চলমান। আমার বাবা মামলার বাদি ছিলেন আমরা বর্তমানে পক্ষ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ মামলার ফল আদৌ পাবে কিনা অনিশ্চিত কারণ এখনো জেলা জজ পর্যায়ে মামলা চলমান।

আমাদের বিচার ব্যবস্থার এ দুর্বলতার কারণে মানুষ আইন, আদালতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং কম্প্রোমাইজ করে হলে ও বিকল্প প্রতিকার যেমন থানার ওসি, ইউএনও, এলাকার রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি এর সালিশি ফোরাম এর শরণাপন্ন হন যা আইনবিরুদ্ধ।

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর অতিক্রম হলেও কোনো সরকার দেওয়ানী কার্যবিধি আইন ১৯০৮, তামাদি আইন ১৯০৮, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭০ ইত্যাদি বহুল প্রচলিত দেওয়ানী আইন এর সংস্কারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয় নাই বরং আরো নানা আইন তৈরি করে ও নানা আইনের সাথে ট্যাগ করে বিচার প্রক্রিয়াকে জটিলতর করেছে।

আমাদের পূর্বসূরি পাকিস্তান পর্যন্ত দেওয়ানী আইনসমূহের আমূল সংস্কার করে ফেলেছে আর আমরা এখনো শত বৎসরের পুরোনো আইন নিয়ে চলতে হচ্ছে। এবার আসি আমার পর্যবেক্ষণে যে সমস্ত কারণে মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে-

মামলার পক্ষগণের কারণে

যদি মামলায় মেরিট কম থাকে তাহলে বাদী বিবাদী উভয়ে নিযুক্তিয় আইনজীবীকে মামলা নানাভাবে দীর্ঘায়িত করার নির্দেশনা দেয় যাতে করে অপরপক্ষ আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যায় এবং বিরক্ত হয়ে নেগোসিয়েশন এ আসে।

আইনজীবীর কারণে

কিছু দেওয়ানী আইনজীবী আইনগত অজ্ঞতার কারণে ভুল ফোরামে মামলা করে, ভুল প্রতিকার চাই যার ফল ভোগ করে মক্কেল এবং একটা বড় সময় চলে যায় মামলার পদ্ধতিগত ত্রুটি তথা প্লিডিংস (আর্জি ও জবাব) সংশোধন করতে এবং সঠিক ফোরামে মামলা করতে। তাছাড়া অনেক আইনজীবীর ধারণা মামলা তাড়াতাড়ি শেষ করলে আয়ের পথ তো বন্ধ হয়ে যাবে বরং এটা চিন্তা করে না তাড়াতাড়ি আইনগত প্রতিকার ফেলে মানুষ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে পাবে এবং আরো বেশি সংখ্যক মানুষ আদালতমুখী হবেন।

প্রোএকটিভ ও মেধাবী জজ এর স্বল্পতার কারণে

দেওয়ানী আদালত গুলিতে দক্ষ, proactive ও মেধাবী জজ এর বড্ড অভাব বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে একটা মামলা কেন নিষ্পত্তি হচ্ছে না সেটার ব্যাপারে খেয়াল রাখা, আইনজীবী কোর্টের অযথা সময় নস্ট করছে কিনা তা ধরতে পারা।

উদাহরণস্বরূপ- জবানবন্দির নামে পুরো আর্জি টা সাক্ষীর সামনে পড়ে শেষ করা, ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করে কাউকে বিরক্ত করছে কিনা ইত্যাদি। তাছাড়া কিছুদিন পর পর জজ দের বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে ও মামলা নিষ্পত্তি দেরি হয় কারণ নতুন জজ তার মতন করে মামলাটা আবার বুঝে এবং আইনজীবীকে বুঝাতে হয়।

আইনি দুর্বলতার কারণে

২০২৪ সালে এসে ও মামলার পক্ষগণের এমন কোনো ফোরাম/অনলাইন ডাটাবেজ/অনলাইন পোর্টাল নাই যার মাধ্যমে সহজেই জানতে পারবে তার বিরুদ্ধে দেশের যেকোন একটি আদালতে তার মালিকানাধীন সম্পত্তির দাবি সংক্রান্ত একটা মামলা রুজু হয়েছে অথবা মামলা চলমান যেখানে তার পক্ষ হওয়া জরুরি।

বর্তমান আইনে অজস্রবার জরিমানা ব্যতিরেকে ও জরিমানাসহ সময় নেওয়া যায়, মামলার বিভিন্ন স্টেপ সম্পাদনের যে সময়সীমা আছে সেগুলো বাধ্যতামূলক নয় বরং নির্দেশনামূলক, নেজারত যোগে সমন, ডাক যোগে সমন, কোর্ট প্রেমিসে লটকিয়ে জারি করার মাধ্যমে সমন, পত্রিকার মাধ্যমে সমন ইত্যাদি প্রসেস বিদ্যমান যা অনেকটা অকার্যকর এবং বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগের সাথে সম্পূর্ন বেমানান।

তাছাড়া মামলার রায় ফেলে ও আলাদাভাবে জারি মোকদ্দমা করতে হয় সেটা ও আরেক জটিল প্রক্রিয়া। বিশাল দেওয়ানী কার্যবিধি আইনকে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে নাহলে দেশের বিচার ব্যবস্থা অচিরেই ভেঙে পড়বে।

ডিজিটালাইজেশন এর অভাব

অধস্তন আদালতের নথি ব্যবস্থাপনা দেখলে মনে হবে এখানে বিচারপ্রার্থীদের মূল্যবান দলিল দস্তাবেজ গুলু এমন অনাদর অবহেলায় রাখা হয় যেকোনো সময় এগুলু হারানো বা মিসপ্লেস হওয়া খুব স্বাভাবিক। সুইট রেজিস্ট্রার, সমন প্রসেস, সালানুক্রমিক মামলার নথি ব্যবস্থাপনা, মামলার আদেশ সমূহ এর ট্র্যাকিং ইত্যাদি ডিজিটাইজ করা প্রয়োজন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা, স্কয়ার গ্রুপ।