মোঃ মামুনুর রশীদ: আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কথিত অন্যান্য অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আটক, বিচার এবং শাস্তি প্রদানের জন্য প্রণীত হয়েছিল যার প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছিল ২০০৯ সালে এবং দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয়েছিল ২০১৩ সালে।
গত জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সময়োপযোগী করতে গত ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ইং তারিখে আবারও খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়। এছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাবিত সংশোধনীর ৩(২)(এ)বলা হয়েছে হত্যা, নির্মূল, দাসত্ব, নির্বাসন, কারাবাস, অপহরণ, বন্দিত্ব, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, ধর্ষণ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ বা অন্যান্য অমানবিক কাজ।
কোনো বেসামরিক জনসংখ্যার বিরুদ্ধে ব্যাপক বা পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ হিসেবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বা রাজনৈতিক, জাতিগত, লিঙ্গ, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় ভিত্তিতে নিপীড়নের অংশ হিসেবে, দেশের অভ্যন্তরীণ আইন লঙ্ঘন হোক বা না হোক তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে ।
সংশোধনী ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্ত্বার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা হবে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীর ১৯(১)ধারায় বলা হয়েছে চৌম্বকীয়, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল বা কম্পিউটার মেমরিতে উৎপন্ন, প্রস্তুত, পাঠানো, প্রাপ্ত বা সংরক্ষিত ডেটা বা তথ্য; অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিং; ডিজিটাল ভার্সেটাইল ডিস্ক (ডিভিডি), ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক (ডিভিডি); মোবাইল ফোন থেকে রেকর্ড; হার্ডওয়্যার, সফ্টওয়্যার, বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস যার সম্ভাব্য মান আছে বলে মনে করা হয়।
সংশোধনীর ৩ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের অনুচ্ছেদ-৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) অপরাধের উপাদানগুলি বিবেচনা করতে পারবে।
সংশোধনীর ১২ (২) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২ এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্টি সাপেক্ষে বিদেশী কাউন্সেলকে তার সামনে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দিতে পারবে, যদি ঐ কৌঁসুলির আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের অনুশীলনে কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকে।
সংশোধনীর ৪(এ) ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল একটি পূর্ণ অথবা আংশিক শুনানির অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে৷ ট্রাইব্যুনাল অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং মর্যাদা রক্ষা করার জন্য আদালতের দ্বারা নির্ধারিত যেকোন শর্ত অনুসারে ইন্টারনেট বা অন্যান্য উপায়ে শুনানির একটি অডিও বা ভিডিও সম্প্রচার বা তার অংশ উপলব্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সংশোধনীর ১৩ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, বিদেশী সরকার, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা ট্রাইব্যুনালের পূর্বানুমতি এবং স্বীকৃতি সাপেক্ষে জনশুনানি, বিচার এবং অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে।
সংশোধনীর ২০ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন এই আইনের ধারা ৩-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত, মদদ প্রদান, প্ররোচনা বা সহায়তা করে বলে পাওয়া যায় তাহলে এই ধরনের সংগঠন সর্বনিন্ম ১০ বছর সময় কালের জন্য নিষিদ্ধ হবে। তবে, ট্রাইব্যুনাল তার বিবেচনার ভিত্তিতে, সংগঠনের দ্বারা দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমাতে পারে।
আরও বলা হয় যে এই ধারার অধীনে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সংগঠনের সমস্ত কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়:
(ক) নির্বাচনে অংশগ্রহণ;
(খ) সভা-সমাবেশ, সমাবেশ বা যেকোনো ধরনের জনসমাবেশের আয়োজন করা;
(গ) প্রচার বা যোগাযোগের জন্য মিডিয়া এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার; এবং
(ঘ) তহবিল সংগ্রহ এবং কোন আর্থিক লেনদেন পরিচালনা।
এই ধারার অধীনে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী যেকোন ব্যক্তি ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নির্ধারিত দণ্ডের জন্য দায়ী থাকবেন।
সংশোধনী প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সংশোধনীতে আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের দিকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে। আসামিদের পাশাপাশি প্রসিকিউশনের পক্ষেও বিদেশি আইনজীবী রাখার প্রস্তাবনা এসেছে এখানে। তবে প্রসিকিউশনের পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকেও আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ আইনে রাখা উচিৎ। এতে ভিকটিমের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আসবে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি বিচারে স্বচ্ছতা আনতে অন্তত একজন আন্তর্জাতিক বিচারপতি রাখা উচিৎ।
মানুষের বুকের ভেতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক— জুলাই আগস্টের খুনের বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার আইন দিয়ে করা যায় না। তাতে সুবিচার নিশ্চিত হয় না। অত্র আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করাই অত্র আইনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ ।
আইনে ডিজিটাল এভিডেন্স গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, তবে ডিজিটাল এভিডেন্স গ্রহণের পদ্ধতি কী হবে সেটা স্পষ্ট করা হয় নাই। বর্তমানে এ আই দিয়ে তৈরি নানা ফেক ভিডিও ও ছবি ইন্টেনশনালি ছড়ানো হচ্ছে, আবার কেউ মোটিভেটেড হয়েও ছড়াচ্ছে। ফলে এই ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত নেওয়ার পদ্ধতি যেন একটি বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় থাকে, সেটা আইনে স্পষ্ট করাটা খুবই জরুরি।
এই আইনের ২০এ ধারা রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এখান প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিষিদ্ধ কী শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ অ্যাক্টিভিটিসকে নিষিদ্ধ করবেন, নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিষিদ্ধ করা হবে। কারণ, সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি রয়েছে। দেশে নিষিদ্ধ হলেও দেশের বাইরে যদি কার্যক্রম চালায়, সে ক্ষেত্রে নিষিদ্ধের এলাকা কোনটা হবে, এটা ঠিক করা হবে কীভাবে?
তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ সংশোধন করে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও বাতিল করার জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
আইনের সংশোধনী এমন হতে হবে, যেন এটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না ওঠে। এই আইনের মাধ্যমে যেন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
লেখক: আইনজীবী- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও পার্টনার –লেক্স স্কয়ার ।