বায়না চুক্তির সম্ভাব্য জটিলতা ও সমাধান : সম্পত্তি হস্তান্তর আইন এবং রেজিষ্ট্রেশন আইন
ব্যারিস্টার সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান

বায়না চুক্তির সম্ভাব্য জটিলতা ও সমাধান : সম্পত্তি হস্তান্তর আইন এবং রেজিষ্ট্রেশন আইন 

বায়না চুক্তি কি?

কোন সম্পত্তির আংশিক মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে উক্ত সম্পত্তি ভবিষ্যত কোন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রয় বিক্রয়ের নিমিত্তে পক্ষগনের মধ্যে যে লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাকে বায়না পত্র বলা হয়। বায়না চুক্তি যেহেতু একটি চুক্তি তাই এটি চুক্তি আইন ১৮৭২ অনুযায়ী এটি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৪এ ধারা অনুযায়ী বায়না চুক্তি সম্পাদন অবশ্যি লিখিত হবে এবং রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর অধীন নিবন্ধিত হয়ে থাকবে। বায়না পত্রে সম্ভাব্য ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে বেশ কিছু শর্তাবলি লিপি থাকে।

যেমন – তফশীলোক্ত সম্পত্তি যদি বাড়ী সহ ভূমি হয় সেক্ষেত্রে বাড়ি ও ভিটির জন্য আলদা মূল্য নির্ধারন, অবশিষ্ট টাকার পরিমান, অবশিষ্ট টাকা কখন প্রদান করা হবে, অবশিষ্ট টাকা কিভাবে প্রদান করা হবে, কত দিনের মধ্যে অবশিষ্ট বা বক্রি টাকা প্রদান করে রেজিষ্ট্রেশন সম্পাদন করতে হবে, বাকি টাকা প্রদান করতে ব্যর্থ হলে বায়না চুক্তি বাতিল, বিক্রেতা বাকি অর্থ গ্রহন সাপেক্ষে কবলা সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে আদালত যোগে মামলা দায়ের করে কবলা সম্পাদন, বায়না গ্রহীতার অনুকূলে দখল হস্তান্তর সহ প্রভৃতি রকমের ক্লস অন্তর্ভুক্ত থাকে।

বায়না চুক্তি কি বায়না গ্রহীতার বরাবরে সম্পত্তিতে মালিকানা সত্ব, দায় বা অধিকার সৃষ্টি করে?

বায়নানামা বা বিক্রয় চুক্তিতে বায়না গ্রহীতার কোনো মালিকানা স্বত্ব , অধিকার বা দায় সৃষ্টি হয়না। বায়না চুক্তি পত্র কোনো মালিকানা দলিল নয়। বায়না চুক্তি হচ্ছে খুব সর্বোচ্চ একটি চুক্তি পত্র। যেহেতু বায়না চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর হয় না বা মালিকানা সত্ব পরিবর্তন হয় না তাই বায়না দলিলকে সত্বের দলিল বলা হয়না। বায়না চুক্তি দলিল মূলে কেউ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারবেনা।

কিন্তু দেখা যায়, বায়না সম্পাদন পরবর্তীতে বায়না দাতা উক্ত সম্পত্তির দখল বায়না গ্রহীতার বরাবর দখল হস্তান্তর করেন। কিন্তু বায়না গ্রহীতা ভূমি ও তফশীলোক্ত সম্পত্তিতে বায়নামূলে উক্ত সম্পত্তি খরিদ করেছেন মর্মে সাইনবোর্ড দেন। অথচ আইন অনুযায়ী বায়না চুক্তি মূলে বায়না গ্রহীতার বরাবরে মালিকানা হস্তান্তর হয়না বা সম্পত্তিতে কোন অধিকার কিংবা দায় সৃষ্টি হয়না।

কারণ বায়না চুক্তি পরেও অবশিষ্ট টাকা বাকি থাকে এবং কবলা সম্পাদন বাকি থাকে। অর্থাৎ মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তর হওয়ার জন্য কবলা সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রেশন হওয়ার পূর্বে শুধুমাত্র বায়না চুক্তিমূলে কেউ বায়না সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেনা। শুধু মাত্র বায়নামূলে ব্যাংক ও বায়না সম্পত্তির বিপরীতে লোন বা মর্টগেজ ইস্যু করেনা কারন বায়নামূলে সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর হয়না।

বায়না চুক্তির সম্পাদন পরবর্তী সময়ে কি দখল হস্তান্তর করা যায়?

বায়না চুক্তি সম্পাদনের সাথে সাথে বায়নাদাতা সরাসরি বায়না গ্রহীতার নিকট দখল হস্তান্তর করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সম্ভাব্য সাফ বিক্রয় কবলার মূল্যায়নের উপর ৩ % ভ্যাট সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে চালানমূলে পরিশোধ করতে হবে। বায়নানামা চুক্তি সংঘটনের সময় যদি বায়নাদাতা দখল হস্তান্তর প্রদান করে থাকেন এবং পরবর্তীতে যদি বায়না গ্রহীতা অর্থ পরিশোধ করে বায়নাকৃত সম্পত্তি কবলা সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয় তখন তখন বায়নাদাতা ১ মাসের মধ্যে নালিশী সম্পত্তি খালি অবস্থায় দখল ফেরত পাওয়ার অধিকারী হয়ে Mahua Khair Vs The State & Another (5 Ex- File Plus, 1)

বায়না চুক্তি দলিল কি রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়?

বর্তমান আইন অনুযায়ী গত ১/৭/২০০৫ ইং তারিখের পরবর্তী সময়কাল থেকে বায়না দলিল নিবন্ধন বা রেজিষ্ট্রেশন অবশ্যই করতে হবে। তবে গত ১/৭/২০০৫ ইংরেজি তারিখের পূর্ব পর্যন্ত যে সকল দলিল স্থাবর সম্পত্তিতে সত্ব সৃষ্টি করেনা সে সব দলিল এর রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ছিলনা। তাই গত ১/৭/২০০৫ ইং তারিখের পূর্ব পর্যন্ত বায়না দলিল রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ছিলনা।

কিন্তু সংযোজিত ২০০৪ সালের রেজিষ্ট্রেশন আইন এর Section 17 (A) অনুযায়ী বায়না দলিল রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সংযোজিত Section 17 (A) (2) নং ধারা অনুযায়ী বায়না দলিল সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে বায়না দলিল রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে যা গত ১/৭/২০০৫ ইং তারিখ থেকে কার্য্যকর হয়েছে।

একই সাথে সংযোজিত Section 54 (A) of Transfer of Property Act অনুযায়ী বায়না দলিল লিখিত ও রেজিষ্ট্রীকৃত হতে হবে। তাছাড়া একই সাথে সংযোজিত Section 21 (A) of Specific Relief Act অনুযায়ী বায়না দলিল নিবন্ধন আবশ্যক এর কথা বলা হয়েছে।

সুতরাং সংযোজিত এই ৩ টি আইন একত্রে অধ্যয়ন করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে বায়না দলিল অবশ্যই লিখিত, নিবন্ধিত ও পক্ষগন কর্তৃক সম্পাদিত হতে হবে। নতুন আইন অনুযায়ী বায়না দলিল নিবন্ধিত বা রেজিষ্ট্রীকৃত না হলে উক্ত অনিবন্ধিত বায়না দলিল দ্বারা কোনো আইনগত প্রতিকার পাওয়া যাবেনা।

তবে ১/৭/২০০৫ ইং তারিখের পূর্ববর্তী সময়ে অনিবন্ধিত বায়না দলিল দ্বারা পক্ষগন আইনগত প্রতিকারের অধিকারী হবেন।

বায়না চুক্তি দলিলে যদি কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ না থেকে থাকে তবে উক্ত বায়না চুক্তির কত দিনের মধ্যে বায়না দাতা কর্তৃক কবলা সম্পাদন করে দিতে হবে?

সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৯০৮ এর ৫৪এ ধারায় বলা হয়েছে, কোন স্থাবর সম্পত্তির বায়নাপত্রে, বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে একটি সময় উল্লেখ করিতে হইবে, যা বায়নাপত্র রেজিস্ট্রেশন এর তারিখ থেকে কার্যকর হবে, তবে যদি কোন সময়সীমা উল্লেখ করা না হয়, তাহলে সময়সীমা ৬ (ছয়) মাস বলিয়া গন্য হইবে। অর্থাৎ বায়না চুক্তিতে কত দিনের মধ্যে কবলা সম্পাদন করতে হবে এই সংক্রান্ত কোনো বিধান না থাকলে সেক্ষেত্রে বায়নাচুক্তি রেজিষ্ট্রেশন এর ৬ মাসের মধ্যে কবলা সম্পাদন করে দিতে ধরে নিতে হবে।

বায়না চুক্তির জন্য বায়না গ্রহীতা যে অর্থ প্রদান করে থাকেন সেই অর্থ কি ফেরতযোগ্য যদি প্রয়োজনীয় শর্ত ভংগের ফলে কবলা সম্পাদন না করা যায়?

বায়নামূলে কবলা পাওয়ার জন্য যখন পক্ষগনের মধ্য চুক্তি সম্পাদন হয় তখন বায়না গ্রহীতা মোট কবলা মূল্যের কিছু অংশ অর্থ বায়নাদাতাকে প্রদান করে থাকেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যখন উভয় পক্ষের সম্মতিতে এই বায়না চুক্তি অগ্রসর হয়না অথবা যখন প্রয়োজনীয় শর্তাবলী ভংগের ফলে উক্ত বায়না চুক্তি অকার্য্যকর হলে তখন বায়না গ্রহীতা থেকে বায়না দাতা বায়না বাবদ যে অর্থ গ্রহন করেছিলেন সেটি কি ফেরত যোগ্য কিনা?

উত্তর হচ্ছে এক্ষেত্রে উক্ত অর্থ ফেরতযোগ্য। বায়না গ্রহীতা এই অর্থ বায়না দাতার নিকট যাচনা করে এই অর্থ আদায় করে নিবেন। এই ক্ষেত্রে বায়না গ্রহীতা চাইলে বায়নাদাতাকে বায়নাকৃত অর্থ পরিশোধের জন্য আইনগত নোটিশ প্রেরন করে তাগাদা দিতে পারেন। উক্ত নোটিশ ভবিষ্যতে Evidence হিসেবে ব্যবহার করা যাবে যদি বায়না গ্রহীতা উক্ত অর্থ আদায়ের জন্য মোকদ্দমা দায়ের করেন।

উক্ত আইনগত নোটিশ মারফত বায়না দাতাকে বায়নাকৃত অর্থ পরিশোধ করার জন্য তাগাদা দেওয়ার পরেও যদি বায়না দাতা অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তবে বায়না গ্রহীতা পুনরায় নোটিশ প্রেরন করতে পারেন। এর পরেও যদি বায়নাদাতা অথবা বায়নাদাতা উক্ত অর্থ ফেরত প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে বায়না গ্রহীতা এই অর্থ আদায়ে মামলা করতে পারবেন এবং এই ক্ষেত্রে তাকে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারধীন আদালতে মানি স্যুট দায়ের করতে হবে।

বায়নার টাকা উদ্ধারের ক্ষেত্রে যেদিন থেকে বিক্রেতা টাকা দিতে অস্বীকার করবেন বা আইনগত নোটিশ পাওয়ার পর টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানালে সেদিন থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।

1981 BCR (AD) 207 এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বায়নাচুক্তি পত্রে যদি এমন কোনো শর্ত থাকে যে পণের অবশিষ্ট টাকা পরিশোধিত না হলে সম্পত্তিতে দাতার পুন:স্বত্ব জন্মাবে এবং গ্রহীতার অগ্রীম প্রদত্ত টাকা বাজেয়াপ্ত হবে তবে চুক্তি অনুযায়ী গ্রহীতার অগ্রীম প্রদত্ত টাকা বাজেয়াপ্ত সহ বায়নাচুক্তি পরিসমাপ্তি ঘটবে। এই ক্ষেত্রে বায়না দাতাকে এই বায়নাকৃত অগ্রিম অর্থ আর ফেরত দিতে হবেনা।

বায়নাচুক্তি সম্পাদন পরবর্তী সময়ে বায়না গ্রহীতা যথাযথ শর্তাবলী পালনের পরেও যদি বায়না দাতার নিকট থেকে কবলা সম্পাদন করে নিতে না পারে সেক্ষেত্রে বায়না গ্রহীতার করনীয় কি?

বায়নামূলে বায়নাদাতা কবলা সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রেশন প্রদান না করলে বায়না দাতার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ১২ ধারা মতে বায়না চুক্তি প্রবল ক্রমে কবলা পাওয়ার মামলা দায়ের করতে হবে। বায়নাচুক্তিতে যদি কবলা সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রেশন বিষয়ক নির্দিষ্ট কোন সময় উল্লেখ থাকে তাহলে সেই সময় উর্ত্তীর্ণ হওয়ার পর দিন হতে পরবর্তী ১ বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।

(তামাদি আইনের ১১৩ নং অনুচ্ছেদ) আবার অনেক সময় দেখা যায়, বায়না চুক্তিতে কবলা সম্পাদনের নির্দিষ্ট কোন সময় উল্লেখ থাকেনা। সেই ক্ষেত্রে বায়নাদাতা চুক্তি পালনে অস্বীকৃতির বিষয় যখন সর্বপ্রথম যখন জানতে পারেন সেই দিন থেকে ১ বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। (তামাদি আইনের ১১৩ নং অনুচ্ছেদ)

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বায়না গ্রহীতাকে বায়নামূলে কবলা পাওয়ার মামলায় বায়নাকৃত সম্পত্তির মোট কবলা মূল্যের উপর এডভোলেরাম কোর্ট ফি বা আনুপাতিক কোর্ট ফি দাখিল করতে হবে ।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ২১এ ধারার বিধান অনুসারে আদালতের মাধ্যমে বায়না চুক্তি প্রবল ক্রমে কবলা পাওয়ার মামলা দায়ের করতে করতে হলে দুটি বাধ্যতামূলক শর্ত পূরণ করতে হবে।

  • বায়না চুক্তিটি লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে;
  • বায়না চুক্তিতে উল্লেখিত বিক্রয়মূল্যের অবশিষ্ট টাকা আদালতে জমা দিতে হবে।

বায়নামূলে কবলা পাওয়ার মামলায় বায়নার বকেয়া টাকা আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ব্যাংকে চালানমূলে বা ব্যাংক ওভারড্রাফট মূলে পরিশোধ করতে হবে।

১ জুলাই ২০০৫ সালের পূর্বে বায়না চুক্তি রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যমূলক ছিলনা, শুধু তাই নয় তখন এই ধরনের মোকদ্দমায় মামলায় ডিক্রি পাওয়ার পরে বিক্রয় মূল্যের অবশিষ্ট টাকা কবলা দলিল সম্পাদন বা রেজিষ্ট্রেশন হওয়ার পূর্বে তা জমা প্রদান করলে চলত। বর্তমানে বায়নার বকেয়া টাকা মামলা দায়েরের সময় অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়।

পক্ষগন যদি কোনো স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্তে বায়না চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সেক্ষেত্রে কি বায়নাদাতা বায়নাকৃত সম্পত্তি অন্য কারো নিকট বায়না চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন বা অন্য কারো নিকট কি হস্তান্তর করতে পারবেন?

না, বায়নাদাতা বায়নাকৃত সম্পত্তি অন্য কারো নিকট বায়না চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন না বা অন্য কারো নিকট বিক্রয় কিংবা হস্তান্তর করে সত্ব ত্যাগ করতে পারবে না।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ধারা ৫৩ (খ) অনুযায়ী বায়নাদাতা নালিশী বায়নাকৃত সম্পত্তি বায়না গ্রহীতা ব্যতীত অন্য কারো নিকট বিক্রয়/ বায়নাচুক্তি/বন্ধক/ দখল হস্তান্তর করতে পারবে না যদি না উক্ত বায়নাচুক্তি আইনানুসারে বাতিল না হয়ে থাকে। যদি বায়নাদাতা এই আইন ভংগ করে অন্য কারো নিকট বিক্রয়/ বায়নাচুক্তি/বন্ধক/ দখল হস্তান্তর করে থাকেন তবে এই রুপ হস্তান্তর বৈধ হবেনা এবং বাতিল হবে।

বায়নার মেয়াদ থাকাকালীন সময়ে বায়না চুক্তির দাতা বা গ্রহীতা কেউ কি একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে?

না, বায়নার মেয়াদ থাকাকালীন সময়ে বায়না চুক্তির দাতা বা গ্রহীতা কেউ কি একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না। কারন বায়না হলো একটি চুক্তি। চুক্তি বলবত থাকাকালীন সময়ে বায়না দাতা ও গ্রহীতা কেউ একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করতে পারবে না। তবে বায়নাতে চুক্তিবদ্ধ তারিখের মধ্যে যদি স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্তে বায়না দাতা কবলা সম্পাদন না দিয়ে থাকেন অথবা বায়না গ্রহীতা যদি বায়নাতে উল্লিখিত শর্তাবলি খেলাপ করেন তবেই তারা বায়নার মেয়াদ সম্পন্ন হওয়ার পর ১ বছরের মধ্যে মামলা করতে পারবেন ।

বায়নাদাতা যদি বায়না গ্রহীতাকে বায়নাতে উল্লেখিত পনের অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে কবলা সম্পাদনের জন্য যাচনা করার পর ও যদি বায়না গ্রহীতা কবলা সম্পাদন করে না নিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বায়না দাতার করনীয় কি?

বায়না চুক্তি দলিলে বায়না দাতা সব সময় Advantageous Position এ থাকেন কারন বায়না চুক্তির মাধ্যমে কখনো সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে না বা বায়না চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বায়না গ্রহীতার বায়নাকৃত সম্পত্তিতে স্বত্ব সৃষ্টি হয় না। সুতরাং বায়না দাতা যদি বায়না গ্রহীতাকে বায়নাকৃত সম্পত্তি বায়না দলিলে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে কবলা কবলা করে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করার পর ও যদি বায়না গ্রহীতা টাকা পরিশোধ করে কবলা সম্পাদন করে নিতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে বায়না দাতার সাথে বায়না গ্রহীতার মধ্যকার আইনানুগ বায়না চুত্তি বা সম্পর্কের অবসান ঘটে।

তবে বায়না দাতা চাইলে বায়না চুক্তির অবসানের পরেও বায়না গ্রহীতার নিকট উকিল নোটিশ প্রদান করে বায়না গ্রহীতাকে অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কবলা সম্পাদন করে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। উক্ত বর্ধিত সময়ের মধ্যে ও যদি বায়না গ্রহীতা কবলা সম্পাদন না করে নেন তবে আরও একবার বায়না দাতার সাথে বায়না গ্রহীতার বর্ধিত বায়না চুক্তির অবসান ঘটবে।

আমি উপরে উল্লেখ করেছিলাম যে, বায়না চুক্তি দলিলে বায়না দাতা সব সময় Advantageous Position এ থাকেন কারন বায়না চুক্তির মাধ্যমে কখনো সম্পত্তি হস্তান্তর হয় না বা সম্পত্তিতে স্বত্ব সৃষ্টি হয় না। যেহেতু গত ১/৭/২০০৫ ইং তারিখের পর থেকে বায়না চুক্তি দলিল রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ১৭ ক ধারা অনুযায়ী রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তাই এটি নি: সন্দেহে বলা যায় বায়না চুক্তি দলিল মতে বায়না দাতা ও গ্রহীতা আইন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বায়না চুক্তিতে আবদ্ধ থাকবেন।

উক্ত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি বায়না দাতার যাচনা বা অনুরোধের পরেও যদি বায়না গ্রহীতা বাকি অর্থ পরিশোধ করে বিক্রয় কবলা সম্পাদন করে নিতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন তাহলে চুক্তি আইন ১৮৭২ অনুযায়ী উভয় পক্ষের মধ্যকার চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কের অবসান ঘটবে।

পক্ষগনের সম্মতিক্রমে কি বায়না চুক্তি দলিল বাতিল করা যায়?

পক্ষগন কর্তৃক সম্পাদিত রেজিষ্ট্রিকৃত বায়না দলিল চাইলেই বায়না দলিলের পক্ষগন সম্মত হয়ে বায়না দলিল বাতিল করার অধিকার সংরক্ষন রাখেন। তবে এক্ষেত্রে পক্ষগনকে রহিতকরন দলিল সম্পাদন করতে হবে এবং সাব রেজিষ্টার অফিসে উপস্থিত হয়ে উক্ত রহিতকরন দলিল রেজিষ্ট্রেশন করে নিতে হবে। উল্লেখ্য, স্থাবর সম্পত্তি যে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের আওতাধীন, সেই সাব রেজিস্ট্রি অফিসেই সকল দলিল দস্তাবেজ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এভাবে রহিতকরন দলিল সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রেশন এর মাধ্যমে বায়না দলিলের পক্ষগন সম্মতি হয়ে তর্কিত বায়না চুক্তি দলিলটি বাতিল বা রহিত করতে পারে।

বায়না চুক্তি দলিলে বায়নাদাতা ও বায়না গ্রহীতার স্বাক্ষর প্রয়োজন আছে কি?

রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ১৭ক ধারা অনুযায়ী সহজ ভাষায় উত্তর হচ্ছে বায়না চুক্তি দলিলে দাতা ও গ্রহীতার উভয়ের সাক্ষর প্রয়োজন। রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ১৭ক ধারায় পরিষ্কার বর্নিত আছে যে অত্র আইনে কিংবা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহাই থাকুক না কেন কোন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য বিক্রয় চুক্তি পত্র অবশ্যই লিখিত, পক্ষগণের দ্বারা সম্পাদিত ও রেজিস্ট্রেকৃত হতে হবে।

অর্থাৎ পক্ষগণের দ্বারা বলতে এখানে দাতা এবং গ্রহীতা কর্তৃক বায়না দলিল বা বিক্রয় চুক্তি সম্পাদনকে বুঝানো হয়েছে।অর্থাৎ বায়না দলিলে উভয়পক্ষের বক্তব্য বর্ণিত থাকবে এবং বায়না দলিল উভয়পক্ষ কর্তৃক সম্পাদিত হতে হবে। শুধু তাই নয় বায়না গ্রহীতাকে বায়না দলিলের সকল পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করতে হবে। তবেই একটি বায়না দলিল পরিপূর্নভাবে সম্পাদিত হবে যদি বায়না দলিল পক্ষগন দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়ে থাকে।

অনেক জেলার সাব রেজিষ্টার বায়না গ্রহীতার স্বাক্ষর ছাড়াই বায়না দলিল রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করে থাকেন। কিন্তু যারা তুলনামূলক দক্ষ ও চৌকষ সাব রেজিষ্টার তারা দাতা এবং গ্রহীতার স্বাক্ষর ছাড়া বায়না দলিল রেজিষ্ট্রেশন করেন না। তাই ভবিষ্যত এর সম্ভাব্য আইনগত ঝামেলা কমাতে ও রেজিষ্ট্রেশন এর বিলম্ব কমাতে বায়না দলিল দাতা ও গ্রহীতা উভয় কর্তৃক সম্পাদিত ও স্বাক্ষরিত হওয়া আবশ্যক।

তবে 53 DLR 262 এর  Abdul Samad Gazi Vs. Abdul Khalil Gazi & Others এ উল্ল্যেখ করা আছে যে বায়না চুক্তি দলিলে গ্রহীতার স্বাক্ষর প্রয়োজন নেই।উল্লেখ্য যে হাইকোর্টের এই রায়টি প্রকাশিত হয়েছিল গত ২৯/১২/২০০০ ইংরেজি তারিখে। অপরদিকে রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ১৭এ  ধারা সংযোজিত হয়েছে গত ১/৭/২০০৫ইং তারিখে।তাই পরবর্তীতে সংযোজিত রেজিষ্ট্রেশন আইন এর ১৭ক ধারা প্রাধান্য পাবে এবং এই ধারা অনুসারে বায়না চুক্তি দলিলে দাতা ও গ্রহীতাকে স্বাক্ষর করতে হবে।

বায়না চুক্তি সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রেশন করার পূর্বে ক্রেতার করনীয় কি?

জমি ক্রয়ের বায়না করার পূর্বে ও পরে ক্রেতার কিছু করনীয় রয়েছে। জমি কেনার প্রথম ধাপেই আসে বায়না করার বিষয়টি।জমি কেনা বা বেচার বিষয়ে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে আলোচনা করার পর প্রাথমিক যে চুক্তি হয়ে থাকে তাই বায়না চুক্তি। বায়না দলিল করার সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয়।

সেগুলো হলো-

  • বিক্রেতার নিকট থেকে সকল বায়াদলিলের ফটোকপি সংরক্ষণ করুন।
  • সকল বায়াদলিলে বায়নাকৃত সম্পত্তির দাগ ও খতিয়ান ঠিক আছে কিনা তা একজন ভালো সিভিল লইয়ারের মাধ্যমে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
  • বায়নাকৃত সম্পত্তি কোন ব্যাংক এর নিকট বন্ধক আছে কিনা তা দেখতে হবে।
  • বায়নাকৃত সম্পত্তি অন্যকারো নিকট বিক্রয় হয়েছে কিনা তা রেজিষ্ট্রেশন অফিস থেকে দায়মুক্তি সনদ বা NOC এর মাধ্যমে জেনে নিতে হবে।
  • দাগের জমি নিয়ে কোন আপত্তি আছে কিনা তা সহকারি কমিশনার, ভূমির কার্যালয় থেকে জেনে নিতে হবে।
  • দাগের জায়গা ঠিক আছে কিনা তা সার্ভে জানা একজন এডভোকেট কমিশনারের মাধ্যমে মাপঝোপ করে জেনে নিতে হবে।
  • যদি আমমোক্তার এর মাধ্যমে কেউ জমি বিক্রয় করেন তা হলে সেই আমমোক্তার দলিল এর বৈধতা আছে কিনা তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সংবাদ এর মাধ্যমে জেনে নিতে হবে।
  • বায়না দলিলে জমির তফসিল, মৌজা, খতিয়ান, দাগ নম্বর এবং জমির চৌহদ্দি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। যে দাগের জমি সেই দাগের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের দাগের জায়গা উল্লেখ করা উচিত
  • সর্বনিম্ন টাকায় বায়না চুক্তি করুন।
  • জমির সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করার পর জমির বিক্রেতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে ব্যর্থ হন, তবে ক্রেতা হিসেবে আপনি কী কী প্রতিকার পাবেন দলিলে তার উল্লেখ করুন।
  • বায়না দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি করে নিবেন। কারণ রেজিষ্ট্রেশনকৃত বায়না দলিল ছাড়া চুক্তি প্রবল/ ভঙ্গের মামলা আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যায়না।
  • বায়নাচুক্তি সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ৩০দিনের মধ্যে চুক্তিপত্রটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিষ্ট্রেশন করে নিতে হবে।
  • দ্রুত বায়নাদাতার নিকট থেকে অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধ করে সাফ বিক্রয় কবলা করে নিবেন।

লেখক :সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান; ব্যারিষ্টার এট ল, লিংকন্স ইন, যুক্তরাজ্য, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল।