এ এন এম ইব্রাহিম খান: আজ ১লা অক্টোবর ২০২৪ জাতিসংঘ ঘোষিত ৩৪তম আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস। এ বছর জাতিসংঘ কর্তৃক এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারন করা হয়েছে– “Strengthening Care and Support Systems for Older Persons Worldwide” সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয় কর্তৃক যার বাংলা প্রতিপাদ্য হিসেবে অনুদিত হয়েছে- “মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য: বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ।”
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রবীণ হিতৈষী সংঘ কেন্দ্রীয় অফিসসহ সারা দেশের ৫৯টি জেলা শাখায় যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি উদযাপন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে থাকে।
জাতিসংঘের ঘোষনা এবং জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী যাদের বয়স ৬০ বছর বা এর বেশি তাঁদেরকে প্রবীণ বলা হয়েছে। প্রবীণ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সর্বপ্রথম যে সত্যটি চোখের সামনে প্রতিভাত হয় তা হল বার্ধক্য, জরা এবং অসহায়ত্ব। বার্ধক্যকে কেউ এড়িয়ে চলতে পারবে না। বার্ধক্যের স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতেই হবে।
উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন কিছুটা শক্ত অবস্থানে থাকলেও অর্থনৈতিক কারণে কখনও কখনও পারিবারিক বন্ধনে শিথীলতাও দেখা যায়। আজকের নবীন আগামী দিনের প্রবীণ উক্তিটা উল্টো করে বললে দাঁড়ায়, আজকের প্রবীণ বিগত দিনের নবীন। অর্থাৎ যারা আজ প্রবীণ, তাঁরাও এক সময় তারুন্য ও যৌবনের উদ্দীপনায় উদ্বেলিত ছিল। সময়ের ব্যবধানে মানুষ পৌঢ়ত্ব বরণ করে নেয়, এটাই সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সারাবিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৮ ভাগ, সেটি এ শতাব্দীর শুরুতে ১১ ভাগ ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০৫০ সাল নাগাদ শতকরা ২২ ভাগ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিশ্বের এ প্রবীণ বৃদ্ধির হারকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বাংলাদেশ।
বিআইডিএস এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪.৯৮ শতাংশ ছিল প্রবীণ জনগোষ্টী, ২০০১ সালে যা দাঁড়ায় ৬.১০ শতাংশ, ২০১৩ সালে যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ শতাংশ এবং এই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২৫ ও ২০৫০ সালে যা দাঁড়াবে যথাক্রমে ১১ শতাংশ ও ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ হবে প্রবীণ।
জীবন মানোন্নয়ন, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসকরণের জন্যই আমাদের দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রবীণদের এ বৃদ্ধির হারকে সমস্যা হিসেবে না ধরে যথাযথ উদ্যোগ নিলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে মূল্যবান জনসম্পদে পরিণত করা যাবে সহজেই।
প্রবীণ জনগোষ্ঠী এ সমাজ ও জাতিরই অংশ। আজকের প্রবীণ লোকটিই একদিন তাঁর সমস্ত শক্তি সামর্থ দিয়ে দেশের এবং পরিবারের চাহিদা মেটাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সুতরাং বার্ধক্যে উপনীত হয়ে তিনি যখন সকল কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ভেতর একটা হতাশা কাজ করে। এ সময় একটু সহানুভুতি, মমত্ববোধ হয়তো তাঁকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দিতে পারে।
কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণদের জন্য পৃথক করে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়নি, কারণ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অুনযায়ী বড়দের সর্বদা সম্মান ও দেখাশুনা করার স্বাভাবিক নিয়ম প্রতিটি পরিবারে পরিলক্ষিত হত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে ভূমি সংকট, বাসস্থান সংকট, জীবিকার তাগিদে পরিবারের সদস্যদের নগরমুখী অবস্থান প্রভৃতি অন্যতম।
বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রধান সমস্যাবলীর মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা অন্যতম। আমাদরে সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে পরিবার হল একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। অতীতে প্রবীণরো যৌথ পরিবারে সকলের নিকট হতে সেবা এবং সহায়তা পেতেন এবং এভাবেই তাদের প্রবীণ সময় কেটে যেতো। পরিবার এবং সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রর্দশনসহ তাদের বেশি যত্ম নেয়ার একটি বিশেষ মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির চর্চা ছিল।
কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে ছোট হয়ে যাচ্ছে। প্রবীণরো হারাচ্ছে তাঁদের প্রতি সহানুভূতি, বাড়ছে অবহেলা আর তারা শিকার হচ্ছেন বঞ্চনার। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় দেখা যাচ্ছে প্রবীণরা প্রথমত নিজ পরিবারেই তাঁদের ক্ষমতা ও সম্মান হারাচ্ছনে এবং ধীরে ধীরে সমাজের সকল কর্মকান্ড থেকে বাদ পড়ছেন। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা আর অন্যদিকে চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে থাকার কারণে তারা পরিবার হতে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সকল ধরনের সেবা পাবার সুযোগ হতে বঞ্চিত।
ফলে প্রবীণ এই জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সামাজকি নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে যা আগামীতে একটি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। সমাজরে বিপুল এ জনগোষ্ঠীকে কোনভাবইে উপক্ষো করার উপায় নেই। তাই বর্তমানে প্রবীণদের উন্নয়নের বিষয়টি জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে বেশ গুরুত্বর্পূণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাস্তবতার নিরীখে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় বৃদ্ধাশ্রম প্রয়োজন সেটা যেমন সত্য, সে সাথে এটাও বেদনাদায়ক যে, সন্তান-সন্ততি সব থাকার পরও একদিন যে মা-বাবা নিজেদের সবকিছু দিয়ে সন্তান মানুষ করেছেন সে সন্তান যখন মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, তার মত দুর্ভাগা আর কে হতে পারে! বৃদ্ধ মা-বাবাকে বোঝা নয় বরং সৃষ্টিকর্তার পরম আর্শিবাদ মনে করতে হবে। বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিজের সাথে রাখলেও কেউ যেন গর্ব করে এই কথটা না বলে যে, “আমার মা-বাবা আমার সাথে থাকেন” বরং এটা বলা উচিত যে, “আমি আমার মা-বাবার সাথে থাকি”।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রবীণদের একটি অন্যতম প্রধান সংগঠন। প্রবীণদের সমস্যা চিহ্নিত করা ও তাঁদের সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাস্থ্যগত সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে ১৯৬০ সালের ১০ই এপ্রিল ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নিজ বাস ভবনে দেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক ও মানবদরদী ব্যক্তিত্ব অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম এমআরসিপি ডিগ্রীধারী প্রফেসর অব মেডিসিন অধ্যক্ষ ডাঃ এ, কে, এম, আবদুল ওয়াহেদ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ নামক এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীতে এ সংগঠনের সাথে দেশের বহু প্রথিতযশা পেশাজীবি, বুদ্ধিজীবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবি, বিচারপতি, শিক্ষক এবং নানান পেশার মানুষ সংশিষ্ট হন এবং এর অগ্রগতি তরান্বিত করেণ। সারা দেশে এ যাবত ৫৯ টি জেলায় এর শাখার মাধ্যমে প্রবীন জনগোষ্ঠীর কল্যানে এ সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।
সকল সার্মথবান নাগরিকের উচিত প্রবীণ হিতৈষী সংঘের কর্মকান্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাধ্যমত সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেয়া। সরকারের কাছেও জোরালো দাবী প্রবীণ নীতিমালার আলোকে প্রবীণদের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি সকল সুবিধার দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।
আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস উপলক্ষ্যে প্রবীণদের আহ্বান প্রবীণদের সম্মান করুন, দেশ গড়ায় তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান, তাদেরকে করুনা নয়, ভালবাসুন। প্রবীণরা দেশের বোঝা নয়, সম্পদ। প্রবীনের যুক্তি আর নবীনের শক্তি- এ দুয়ে মিলেইতো সমাজের মুক্তি।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ও প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, চট্টগ্রাম শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য। ই-মেইল: ibrahimkhan1965@yahoo.com