সংস্কার আসুক আদালতের নাম ও বিচারকের পদবি ব্যবহারের প্রচলিত  রীতিতে
মতিউর রহমান; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

সংস্কার আসুক আদালতের নাম ও বিচারকের পদবি ব্যবহারের প্রচলিত  রীতিতে

মতিউর রহমান: গত ২১/০৯/২৪ তারিখে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের অভিভাষণের ভাল লাগার অনেক বিষয়ের মধ্যে আমার নিকট সবচেয়ে বেশি যেটি ভাল লেগেছে তা হলো একবারের জন্যও “নিম্ন আদালত” শব্দ ব্যবহার না করে সচেতনভাবেই “জেলা আদালত” শব্দের ব্যবহার।
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সবকিছুর জন্য সম্বোধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা ঘাউড়া মজিদ, বুলু চোরা, চিটার বাবু, মুরগি মিলন, জংগি সাইফুল ইত্যাদি নাম বিভিন্ন সময়ে মামলার নথিতে, নিউজে ও বিনোদন মাধ্যেম দেখেছি, শুনেছি। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে টাইগার, বিড়াল উভয় নামেই সম্বোধন করতে শুনেছি। প্রকৃত নামের পূর্বে যে শব্দ সংযোজন করে সম্বোধন করা হয় সেটি দিয়ে মূলত উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রকাশ পায়।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে বিকৃত নাম হেয় করে, হীনমন্যতায় ভোগায় এবং অপরাধপ্রবণ করে তোলে। বিচারক,আইনজীবী , মিডিয়া ও সাধারণ মানুষ অধিকাংশই জেলা আদালতকে “নিম্ন আদালত” (Lower Court) হিসেবে সম্বোধন করেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ের আদালতকে কেন  পূর্বে নিম্ন শব্দের সংযোজন করে সম্বোধন করা হয়? গত অভিভাষণ অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তারা নিম্ন আদালত শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু, জেলা আদালত সম্পর্কে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের ইউনিক সম্বোধনেই প্রকাশিত হয় স্যার সমগ্র বিচার বিভাগকে কতটা উচ্চাসনে ধারণ  করেন।
রাষ্ট্রের অন্যতম অংগ বিচার বিভাগের কোন অংশই নিম্ন হতে পারে না। আইনে কোথাও “নিম্ন আদালত”(Lower Court) শব্দ ব্যবহার করে নামকরণ করা আছে কি না তা চোখে পড়েনি। সংবিধানে উল্লিখিত “অধস্তন আদালত”(Subordinate Court)  শব্দ নিয়েও আপত্তি আছে। আদালত প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ায় প্রশাসনিক অধস্তন হতে পারে কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। তাই শুধু প্রশাসনিক ধারণায় জেলা আদালতের পুরো নাম “অধস্তন আদালত ” হওয়া সমীচীন নয়। আবার, উচ্চ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট) আছে তার মানে অন্য আদালত নিম্ন আদালত হিসেবে সম্বোধিত হবে এমনটা যৌক্তিক নয়।

আরও পড়ুন: বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ, এখন প্রয়োজন সরকারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ

রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের জেলা পর্যায়ের অংশকে জেলা প্রশাসন নামে সম্বোধন করা হয়, নিম্ন প্রশাসন বলা হয় না।  তাহলে, বিচার বিভাগের জেলা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের নাম “জেলা বিচার বিভাগ বা জেলা আদালত” হওয়া যৌক্তিক নয় কি? সংস্কারের এই সময়ে নিম্ন আদালতের পরিবর্তে “জেলা আদালত” হিসেবে সম্বোধনের রীতিতে পরিবর্তন আসুক।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় অভিভাষণে যেভাবে “জেলা আদালত” হিসেবে সম্বোধন করেছেন সেইভাবেই সম্বোধন প্রচলন হোক। সংবিধানেও অধস্তন আদালতের পরিবর্তে জেলা আদালত শব্দ অন্তর্ভুক্ত করা হোক। আমরা কিছুদিন পূর্বে ভারতের প্রধান বিচারপতির বক্তব্য শুনেছিলাম যেখানে তিনিও নিম্ন/অধস্তন আদালতের পরিবর্তে জেলা বিচার বিভাগ সম্বোধনের আহবান করেছিলেন। সম্বোধনে আমাদের চিন্তাভাবনার সামান্য পরিবর্তন ন্যায়বিচারের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান জেলা আদালতের বিষয়ে বিভ্রান্তি ও মর্যাদাহানি  হতে রক্ষা করে।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় তার অভিভাষণে মাসদার হোসেন মামলা, অল ইন্ডিয়া জাজেস এসোসিয়েশন মামলার উল্লেখ করে বিচারকদের অবস্থান, চাকুরীর প্রকৃতি ও আদেশের বাধ্যবাধকতা যেভাবে অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চেয়ে আলাদা তা সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। তিনি উক্ত রায় গুলোর আলোকে সুন্দর করে ব্যখা করে বুঝিয়েছেন যে, একজন সহকারী জজ বিচার বিভাগের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ করেন যা রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর উপর বাধ্যকর।
সহকারী জজ কোন ভাবেই জেলা জজের অর্পিত দায়িত্ব একজন সহকারী হিসেবে পালন করেন না। কিন্তু, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের উর্ধ্বতনের অর্পিত দায়িত্ব সহকারী হিসেবে পালন করেন। যেহেতু একজন সহকারী জজ চাকুরীর প্রকৃতি ও মর্যাদাগত কারণে অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চেয়ে আলাদা, সেহেতু পদবির নামে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনুকরণে “সহকারী’ শব্দের বিলোপ করা আবশ্যক । ভারত ও পাকিস্তানের মতো উক্ত পদের নাম “সিভিল জজ’ হতে পারে বা ‘উপজেলা জজ’ হতে পারে।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি সিভিল কোর্টস এক্ট সংশোধন করার বিষয়ে বলেছেন। উক্ত আইনটি যদি সংশোধন করা হয় তাহলে এই পদের নাম পরিবর্তন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি। সহকারী জজ বলতে জজের সহকারী, পেশকার বা আধা-জজ হিসেবে জনমনে যে বিভ্রান্তি আছে তা দূর হওয়া প্রয়োজন। বিচারকের পদবি নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি থাকলে আদালতের প্রতি আস্থার ঘাটতি থাকে। ‘সহকারী’ শব্দটি ‘সহকারী জজ’দের ক্ষেত্রে পূর্ণাংগ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড), সহকারী পুলিশ সুপার (এ এসপি) ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত নামে পরিচিত হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি হয় না। সহকারী জজ আদালতের প্রতি জনমনে বিভ্রান্তি দূর করে আস্থা আনয়ন করার লক্ষ্যে এই পদের নাম পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শই লক্ষ্য করা যায় “জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ” এর পরিবর্তে “বিচারিক হাকিম” শব্দ ব্যবহৃত হয়। আবার, “চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত” এর পরিবর্তে “মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত’, ” চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ” এর পরিবর্তে ‘মুখ্য মহানগর হাকিম’ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ম্যাজিস্ট্রেট শব্দের বাংলা অর্থ “হাকিম” মর্মে দাবি করে অনেকেই এই সম্বোধনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
হাকিম মূলত একটি আরবি শব্দ যার অর্থ একজন “জ্ঞানী ব্যক্তি” বা “চিকিৎসক” বা সাধারণভাবে, ভেষজ ওষুধের একজন অনুশীলনকারীকে নির্দেশ করে , বিশেষ করে ইউনানি এবং ইসলামিক ঔষুধের।
উর্দু : حکیم  ও হিন্দি : हकीम ( হাকিম) শব্দটিও প্রাচ্য চিকিৎসার অনুশীলনকারীদের জন্য ব্যবহৃত হয়  যারা দেশীয় ওষুধের পদ্ধতিতে পারদর্শী। ইসলামিক স্বর্ণযুগে হাকিমকে আরও সাধারণভাবে ব্যবহার করা হতো পলিম্যাথ পণ্ডিতদের বোঝাতে যারা ধর্ম, চিকিৎসা, বিজ্ঞান এবং ইসলামী দর্শনে জ্ঞানী ছিলেন। (সুত্র: উইকিপিডিয়া)
বাংলাদেশ,ভারত,পাকিস্তানে , হাকিম বা হেকিম একজন ভেষজ ওষুধের চিকিৎসককে বোঝায়, বিশেষ করে ইউনানি ওষুধের। তবে, হাকিম (বিকল্প প্রতিলিপি Hakem) মানে একজন শাসক, গভর্নর বা বিচারক হিসেবেও প্রচলিত আছে । কুয়েত,লিবিয়া, ইয়েমেন ও ইরানের কিছু প্রদেশে হাকিম মানে প্রশাসক ও সরকারের অংশ। ইন্দোনেশিয়া, মালোয়েশিয়া ও তুরস্কে হাকিম অর্থ বিচারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে সাধারণত সংবাদমাধ্যমে ‘জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’ এর পরিবর্তে ‘বিচারিক হাকিম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
আবার, সাব-রেজিস্ট্রাররাও সাধারণ মানুষদের মাঝে হাকিম নামে পরিচিত ও হাকিম নামেই সম্বোধিত হয়। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমে বিচারিক হাকিম শব্দ  ব্যবহার হলেও ‘এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ এর ক্ষেত্রে ‘নির্বাহী হাকিম’ শব্দের ব্যবহার খুবই কম দেখা যায়। বাংলা প্রচলনের দোহাই দিয়ে ‘বিচারিক হাকিম’ শব্দ ব্যবহার করা হলেও বাংলিশ ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দ কিভাবে ব্যবহার হয় তা বোধগম্য নয়। এস. পি., ডি. সি. ও সিভিল সার্জন শব্দের বাংলা কেন ব্যবহৃত হয় না তা বোধগম্য নয়। সংবাদ মাধ্যমের এই ধরনের দ্বিচারিতার ব্যাখ্যা  অবশ্য পাওয়া যায় না।
জেনারেল ক্লজেস এক্ট, ফৌজদারি কার্যবিধি ও বাংলাদেশ সংবিধানে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও পদবির ক্ষেত্রে  “ম্যাজিস্ট্রেট” শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের বাংলা ভার্সনেও ‘ ম্যাজিস্ট্রেট ‘ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। আইনের ব্যাখ্যা অনুসারে ফৌজদারি ক্ষুদ্র অপরাধের বিচারের ক্ষমতা ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে প্রদত্ত ক্ষমতার চর্চাকারী আদালত “ম্যাজিস্ট্রেট আদালত”। আদালতকে ও আদালতের প্রিজাইডিং অফিসারকে আইনে সংজ্ঞায়িত নাম ও পদবিতেই সম্বোধন করা উচিত। আইনে নির্ধারিত নাম ও পদবি ব্যাতিত অন্য নামে সম্বোধন করলে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
তাছাড়া,  আদালতের নাম ও বিচারকের  পদবি  বিকৃতি আদালতকে হেয় করা যা আদালত অবমাননার সামিল হতে পারে। আদালতের সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা ও জনমনে বিভ্রান্তি দূরীকরণে আদালতের নাম,  বিচারকের পদবি ব্যবহারে ও সম্বোধনে সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রত্যাশিত।  সংস্কারের এই সময়ে আদালতের নাম ও বিচারকের পদবি ব্যবহারের প্রচলিত এই রীতিতে সংস্কার প্রত্যাশা করি।
লেখক: মতিউর রহমান, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বাগেরহাট।