অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: শুরুতেই বলে রাখি, জনগণের করের টাকায় বেতনভুক্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই জনগণের প্রশাসক হতে পারেন না। তাই জনপ্রশাসন ও জেলা প্রশাসক শব্দদ্বয় যথাযথ নয়। সময় এসেছে এসব চিন্তা করার। ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। কারণ, জনপ্রশাসন শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বীজ। কাজেই আধুনিক বাংলাদেশের সেবা ব্যবস্থাপনা থেকে জনপ্রশাসন ও জেলা প্রশাসক শব্দটি বাতিলের জোর দাবী জানাচ্ছি।
সরকারের পক্ষ থেকে সবসময়ই জোর দিয়ে বলা হয় ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলার কোন বিধান বা আইন নেই। বরং সেবা করাই সরকারি কর্মকর্তা—কর্মচারীদের কাজ। সংবিধান অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করা কতটা যৌক্তিক।
১৯৯৮ সালের কথা। সে বছর কুষ্টিয়াতে বেশ বন্যা হয়েছে। খোকসার কমলাপুর গড়াই নদী তীরবর্তী কমলাপুর গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষ খোকসা গার্লস হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। সাংবাদিকতা করার সুবাদে বন্যা কবলিত মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে প্রতিবেদন তৈরীতে ব্যস্ত। এবার বক্তব্য নেওয়ার পালা টিএনও মহোদয়ের। খোকসার টিএনও তখন কাইয়ুম সাহেব। একটি টিএন্ডটি ফোন থেকে যথারীতি সালাম দিয়ে ওই টিএনও’কে বলেছি মাত্র, ‘ভাই যে বিষয়ে ফোন দিয়েছি…।’
এরপর তিনি আর এগোতে দেননি আমায়। ওখানেই থামিয়ে দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আগে বলেন, আপনি টিএনও’কে ভাই কেন বলছেন। আমি আপনার কেমন ভাই?’ এমন প্রশ্নের জন্য নিশ্চয়ই আমি তৈরী ছিলাম না। এরপর বিনয়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম তাহলে কীভাবে সম্বোধন করব আপনাকে? ‘স্যার’ বলব কি? বিরক্ত টিএনও আমাকে জানিয়ে দেন, ‘আপনার ভাব বেশি। আপনার স্যার ডাকতে হবে না। কিন্তু কখনোই ভাই ডাকবেন না। এটা ফরমাল কোনো ডেকোরাম না।’ মহাবিপদ! ভাইও নয়, স্যারও নয়। তাহলে আমি টিএনও’কে কী বলে সম্বোধন করব, দয়া করে পাঠকই জবাব দেবেন।
ভাই বলে সম্বোধনে আমলাদের আপত্তি, বিরক্তি, অস্বস্তি, উষ্মা প্রকাশ নতুন কিছু নয়। সম্ভবত ২০২০ সালের অক্টোবরে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঠিক একইভাবে সাবধান কতেবে ব্যতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রম সেসময়ের জেলা প্রশাসক আব্দুস সালাম। আমি ঘটনাটি অবহিত করে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো সাংবাদিকদের সহকর্মীই মনে করি। আমরা তো কাউকে বলতে পারি না, আমাকে স্যার ডাকেন। এটা নিয়মের মধ্যেও পড়ে না।’
সম্বোধন নিয়ে আপত্তির মধ্যে জনগণ সরকারি কর্মকর্তা—কর্মচারীকে ‘স্যার নাকি ভাই কী বলে ডাকবো জানতে চেয়ে ২০১২ সালে তথ্য অধিকার আইনে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলাম। তার জবাবে বলা হয়, ‘সম্বোধনসংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে নেই।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান। ‘স্যার না ভাই নাকি অন্য কিছু’ বিতর্কের দিকে ইঙ্গিত করে দুদক কার্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা চাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সেবাগ্রহীতা নাগরিকদের “স্যার” সম্বোধন করবেন, নাগরিকেরা নয়।’
আমি বেশ কিছু দেশ পেশাগত কাজে ঘুরেছি। বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে (নাগরিকেরা)। এ দেশেও এ সংস্কৃতি শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বছরখানেক আগে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো একটা ক্লিয়ার মেসেজ গেছে। আমি বলে দিয়েছি, স্যার বা ম্যাডাম বলার কোনো বিধান নেই। কোনো আইনে নেই যে তাকে এটা বলতে হবে। আমাদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হলে কেউ যদি ভাই বলে, রাগ করার তো কিছু নেই। আমার কাজটা হচ্ছে আপনাকে সার্ভিস দেওয়া।’
তবে শেষ কথা হচ্ছে ‘সালিস মানি, কিন্তু তাল গাছটা আমার’ মনোভাবে কোনো ছেদ বা বিরামচিহ্ন পড়েনি। ‘স্যার’ সম্বোধন আদায়ের জন্য ছোটবড় নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমলাদের ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যেই নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যেও এ প্রবণতা বেশী দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৪ সাল। কুষ্টিয়া বিআরটিএ ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবির’কে স্যার সম্বোধন না করায় আমার এক সহকারীকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল।
এ বিষয়ে আমি জানতে চেয়ে সরেজমিন তার অফিসে গেলে আমাকে র্যাব ডেকে র্যাবের হাতের তুলে দেয়ার হুমকি দেন। তখনকার ফ্যাসিস্ট র্যাবের আচরণ সম্পর্কে এখন আর না বলাটাই শ্রেয়।
আমার শিরোনামের শব্দগুলো কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত কলোনিগুলোর।। ব্রিটিশরা নিজের দেশে নাম বা পদ ধরে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু রাখলেও উপনিবেশের বাসিন্দাদের প্রভু মানে ‘স্যার’ সম্বোধন শিখিয়েছেন। কালে কালে ‘স্যারের’ শিকড়টা এমন গভীরে চলে গেছে যে এখন বড় কর্তার সব কথার উত্তর ‘স্যার’ শব্দ দিয়েই দেওয়া যায়। হ্যাঁ বাচক, না বাচক যাই হোক এক ‘স্যার’ দিয়ে সেরে ফেলা যায় কথোপকথন। দার্শনিক বাট্রর্ান্ড রাসেল যেমন বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেই দুর্বল মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়।’
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা আছে। প্রায় ৪০ বছর আগের এই আচরণবিধি অবশ্য ২০০২ সালে ও ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি নির্দেশনা থাকলেও দুঃখের সাথে জানাতে হয় নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই।
অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমনটি লেখা আছে। সেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে, অসংগত আচরণ, চাকরি—শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। তবে এসবের বিস্তারিত আলোচনা সেখানে নেই।
ভুলে গেলে চলবে না সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করার বিষয়টি কতটা ন্যায্য, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনের শিক্ষক।