রাকিব হাসান জিসান: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর পরই গত অর্ধ যুগ কিংবা তারো বেশি সময় ধরে নিখোঁজ হওয়া কয়েকজন ব্যক্তি আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন, তাদের ব্যাপারে তৎকালীন সময়ে সরকারের প্রতিটি দপ্তরেই খোঁজ নিয়েছিলেন ‘নিখোঁজ’ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা, কিন্তু খোজ মিলেনি কারোরই।
অনেক ব্যক্তিকেই নিখোঁজ হওয়ার বেশ কিছুদিন দিন পর ফিরে পেয়েছেন স্বজনেরা, চোখ বাধা অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, অনেককেই আবার নির্দিষ্ট সময় পর বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমন ঘৃণ্য কাজ শুধুমাত্র আওয়ামী লীগই নয়, বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত দলগুলোও কালো আইনের উপর ভর করেই নানাবিধ অসৎ স্বার্থ হাসিল করে থাকে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও অনেক ব্যক্তিদের স্বাক্ষাৎকার প্রকাশ পেয়েছে আয়নাঘর সম্পর্কিত ভয়ানক তথ্যাদিসহ, যেখানে সকলের বক্তব্যের সংশ্লিষ্টতা ধরে বলাই যায়, বিগত সরকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বস্তুতে পরিনত করেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদেরকে ‘আয়নাঘর’ খ্যাত বন্দিশালায় আটকে রেখেছিলো। এখন প্রশ্ন হলো এমন মানবাধিকার বিরোধী ঘটনায় আমাদের দেশের প্রচলিত আইনি ভূমিকা কি ছিলো? এদের বৈধতা দানের কি উপকরণ-উপায় ছিলো সরকারের হাতে?
আপনারা জেনে অবাক হবেন, আমাদের দেশে মানুষকে গুম করার পর তাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিশেষ আইনি বিধান আছে, বিশেষত এই বিধানগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জোরপূর্বক অন্তর্ধান করার জন্যেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যাকে সবাই আদর করে ‘গুম’ বলে থাকি। বলছিলাম, স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর কথা, যা দেশের আইন অঙ্গণে ‘নিকৃষ্টতম কালো আইন’ হিসেবেই সুপরিচিত।
আইনের মারপ্যাঁচে একজন ব্যক্তিকে, স্পষ্ট করে বলতে গেলে ‘সরকারের বিরোধিতাকারীদের’ বিনা বিচারে কথিত আইনের মারপ্যাঁচে দীর্ঘকাল আটক রাখাই এই কালো আইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সাধারণ ব্যক্তি হিশেবে অবাক হবেন জেনে, এই আইনের ধারা-৯ এর অধীনে বিচারপতি কিংবা সমমান পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে একটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করে থাকে সরকার যারা আটকের সম্পূর্ণ ব্যাপার তদারকি করে থাকে, সংবিধান ও ফৌজদারি আইনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান থাকলেও এই আইনে শুধুমাত্র আটকের কারণসমূহ সরকারের কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্য সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় দিয়েছে।
আরও পড়ুন: জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত!
অর্থাৎ ১৪তম দিনের মধ্যেও আপনাকে আটকের খবর না জানালেও কোন সমস্যাই হবেনা, গঠিত উপদেষ্টা বোর্ড সরকারের কাছে আটক ব্যক্তি সম্পর্কে প্রতি ১৭০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট করতে হবে যদিও এই আইনে আটক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া অস্পষ্ট কিছু মেয়াদ উল্লেখ আছে তা থাকলেও এই ব্যাপারে কেয়ার করা হয়না বরং এই ধারাতেই আইনের দোহাই দিয়ে গুম করে রাখা ব্যক্তিদের কথিত অপরাধের বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
বিচারকার্যে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার, তবে এই আইনের ধারা ১১(৪) অনুযায়ী কথিত অপরাধীকে আইনজীবীর সাহায্য নেওয়া থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থাও আছে যা স্পষ্টত মানবঅধিকার লঙ্ঘন।
ধারা-২৭ অনুযায়ী অপরাধীর অনুপস্থিতেই শুধুমাত্র এস আই পদমর্যাদার ব্যক্তির রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারবে, কতটা ভয়ংকর বিধান ভাবা যায়? এই ধারাতেই স্পষ্টত বুঝা যায় যে, এটা নিঃসন্দেহে কালো আইন, যা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে।
এমনকি এই আইনের ধারা-৩৪ এর বিধানুসারে আটকের নাম করে গুমের মতো কর্মকান্ডের বিচার চেয়ে দেশের যেকোন আদালতেও কোনরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবেনা, সব কিছুই আইনের অধীন জনকল্যাণে রাষ্ট্রের স্বার্থে সরল-বিশ্বাস হিসেবে বিবেচিত হবে, এমনকি এই আইনের ৩৪-ক ধারার অধীনে অপরাধীর বিচারের রায়ের পর শাস্তি নিশ্চিতে গুলি করে হত্যার বিধানও রাখা হয়েছে! জানিনা এই বিধানকে কাজে লাগিয়ে ক্রস ফায়ার নামক নাটক মঞ্চস্থকে বৈধতাও দেওয়া হয় কিনা!
আরো অনেক কিছুই বলার আছে, আইনজ্ঞদের বিশ্লেষণের দাবি রাখে, আমি আইনের ছাত্র হিশেবে বিশ্বাস করি, এই আইনের সংস্কার সম্পর্কে প্রতিটি সেক্টর থেকে আওয়াজ তুলতে হবে, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট নিয়ে যেমন সবাই সরব আছেন একই ভাবে নতুন বাংলাদেশের কল্যাণার্থে এই কথিত জনকল্যাণের নাম ভাঙ্গিয়ে মানবতাবিরোধী ‘গুমের’ মতো নিকৃষ্ট কাজকে বৈধতা দেওয়া এই কালো আইনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং প্রয়োজনে বিশেষ অংশ বাতিল করা আবশ্যিক, করতেই হবে।
এই আইনের অধীনের গঠিত পূর্বের বোর্ড সদস্যদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ন্যায় বিচারের মুখোমুখি করতে হবে, অন্যথায় নতুন স্বাধীনতার স্বাদ অবমূল্যায়িতই থেকে যাবে।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।