মো: জামাল হোসাইন: ফ্ল্যাট এর মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হলেন দীপ্ত টিভির সংবাদকর্মী। এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো আবাসন খাতের চলমান দুর্বৃত্তায়ন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আবাসন খাতে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনেক ভূঁইফোড় ডেভেলপার কোম্পানি আছে যারা সম্পূর্ণ নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে এই খাতে সংস্কার করার।
ব্যাংকিং ব্যবসায় আসতে হলে যেরকম ৪০০ কোটি টাকা সিকিউরিটি মানি বাংলাদেশ ব্যাংক এ জমা রাখতে হয় ঠিক তেমনি এরকম একটা রেগুলেটরি বডি দরকার যারা আবাসন ব্যবসা করতে হলে সেরকম একটা আমাউন্ট জমা রেখে, আরো কিছু যোগ্যতার বেঞ্চমার্ক পূর্ণ করেছে মর্মে সন্তুষ্ট হয়ে ব্যবসার অনুমতি দিবে। এটা নিশ্চিত করা গেলে যে কেউ এ ব্যবসায় আসতে পারবে না এবং কোনো ধরনের প্রমাণিত প্রতারণা করলে সে টাকা থেকে ভুক্তভোগী কে ফেরত দেওয়া যাবে।
আবাসন ব্যবসা হলো কই এর তেলে কই ভাজা এর ব্যবসা এখানে ফ্ল্যাট ক্রেতার টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট প্রস্তুত করে প্রফিট নিশ্চিত করা হয়। এ ব্যবসায় ব্যবসায়িক নৈতিকতা যেমন ভূমি মালিকের অংশ চুক্তি অনুযায়ী সময়মত বুঝিয়ে দেওয়া, প্রজেক্ট এর কাজ চুক্তিতে উল্লেখিত ডেডলাইন এর মধ্যে শেষ করা, স্বচ্ছতার সহিত full disclosure নীতি অনুসরণ করে সকল ফ্ল্যাট বিক্রি করা ও সময়মত দখল ও রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া ইত্যাদি বলে যে একটা জিনিষ আছে সেটা সম্পূর্ন তাদের ধর্তব্যের মধ্যে না রেখে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: দণ্ডবিধিতে সাধারণ ব্যতিক্রমসমূহ ও ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার ব্যপ্তি
এরকম বেপরোয়া আচরণ এর প্রতিবিধান কল্পে রেগুলেটরি বডি হিসেবে রিহ্যাব এর ভূমিকা খুবই গৌণ। আজ পর্যন্ত রিহ্যাব এ গিয়ে কেউ প্রতিকার পেয়েছে সেটা শুনি নাই। ডেভেলপার এর সাথে আপোষে সমাধান এর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হলে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেয় এবং এ সমস্যার শেষ ই আর হয় না।
ডেভেলপার তার প্রভাব খাটিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন আদালত থেকে প্রতিকার নিয়ে আসেন। আর এটার ভুক্তভোগী হয় জমির মালিক, ফ্ল্যাট ক্রেতা সর্বোপরি পুরো আবাসন খাত। টিভি সংবাদ হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী Pleasant প্রপার্টিজ নামের আবাসন কোম্পানিটা ভূমি মালিক কে রেজিস্ট্রিকৃত চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্ত ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে অন্য একজন এর নিকট অরেজিস্ত্রীকৃত বায়নামূলে হস্তান্তর করেন যা সম্পূর্ণ বেআইনি কারণ “one can not transfer any property upon which he/she has no title”.
আমার বাসার পাশে একটা ভবন ২০১৬ থেকে নির্মাণ চলমান মাঝখানে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিলো সম্ভবত মামলার কারণে। ২০২৪ সালে এসে ও এখনো নির্মাণ কাজ শেষ হয় নাই। দেখলাম এটা ও pleasant প্রপার্টিজ এর প্রজেক্ট। যে মুহূর্তে রেজিস্ট্রিকৃত চুক্তি ও আমমোক্তার নামা দলিল মূলে নির্মাণাধীন প্রজেক্ট এর ফ্ল্যাট গুলো ভাগাভাগি হয় সেমুহূর্তে ঐ প্রজেক্ট এর ভাগাভাগি করা ফ্ল্যাট ও ইহার বিপরীতে অবিভক্ত ও অবিভাজ্য ভূমির অংশ ভূমিমালিক ও ডেভেলপার এর উপর বর্তায়।
ডেভেলপার কর্তৃক ভূমি মালিকের অংশের ফ্ল্যাট হস্তান্তর এখানে দুইভাবে হতে পারে বলে মনে হচ্ছে-
প্রথমত, প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে ক্রেতাকে চুক্তি ও পাওয়ার দলিলে স্পেসিফিক ফ্ল্যাট ডেমারকেশন (অধিকাংশ সময়ে পাওয়ার দলিলে কোন ফ্লোর, কোন ফ্ল্যাট নং এর কে মালিক তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা না থেকে শুধু ৫০%:৫০% মালিকানার উল্লেখ থাকে পরবর্তিতে তিনশো টাকার স্ট্যাম্প এর চুক্তিতে সুনির্দিষ্ট ডিমার্কেশন উল্লেখ করা হয়) না থাকার সুযোগে misrepresent করে বরাদ্দপত্র ইস্যু করা।
দ্বিতীয়ত, ক্রেতা ও বিক্রেতা যোগসাজশে ফ্ল্যাট ক্রয় হতে পারে এবং বলপ্রয়োগে পরে দখল নেওয়ার চিন্তা থাকে। আবাসন খাতের জন্য প্রযোজ্য রিয়াল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এ বরাদ্দপত্র (কিছু ডেভেলপার কোম্পানি এর লেটারহেড এ বরাদ্দপত্র ইস্যু করে, কিছু ডেভেলপার তিনশ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এ চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ফ্ল্যাট বরাদ্দ করে থাকে) ইস্যু করার মাধ্যমে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট হস্তান্তর করার কথা বলা আছে যা নির্মাণ সমাপ্ত হয়ে গেলে রেজিস্ট্রেশন ও দখল প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন: ধর্মীয় স্বাধীনতায় ইসলামিক মূল্যবোধ এবং দেশ বিদেশের আইন
এ আইনের কোথাও বরাদ্দপত্র রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয় নাই। এ প্রভিশন ডেভেলপার কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে যাতে করে ক্রেতাদের খরচ না বেড়ে যায়। অপরদিকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২৭ক ধারা মতে যেকোনো অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের চুক্তি রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক। খুব কমসংখ্যক ক্রেতা বায়না রেজিস্ট্রি করে ফ্ল্যাট ক্রয়ের চুক্তি করে থাকে যার কারণে একই ফ্ল্যাট অন্য কারো বরাবরে বায়না করেছে কিনা সেটা রেজিস্ট্রি অফিসে থেকে তল্লাশির মাধ্যমে জানা সম্ভব হয় না।
এক্ষেত্রে ডেভেলপার কোম্পানি তার সুনামের কথা যদি বিবেচনায় নিয়ে কোনো ধরনের অসততার আশ্রয় না নেয় তাহলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। ভুঁইফোড় ডেভেলপার গুলো এ কাজ প্রতিনিয়ত করে থাকে কারণ তাদের সাসটেইনেবল কোনো বিজনেস পলিসি থাকে না বরং দুই একটা প্রজেক্ট এ বাটপারি করে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার ধান্ধায় থাকে। এধরনের ঘটনা ঘটার পিছনে ভূমি মালিকদের ও দায় আছে।
ভালো ডেভেলপার রা প্রজেক্ট ওনারশিপ ও সাইনিং মানি কম দেয় কিন্তু কমিটমেন্ট ঠিক রাখে অন্যদিকে খারাপ ডেভেলপাররা সাইনিং মানি ও প্রজেক্ট ওনারশিপ বেশি দেওয়ার টোপ দেয়। DBH এ আমার চাকুরিকালীন সময়ে আবাসন খাতের এসব বিষয় আমি নিজ চোখে দেখেছি এজন্যে অনেক ডেভেলপার কে ব্ল্যাকলিস্ট করতো এবং ফাইন্যান্স করতো না। অতএব ভূমি মালিকদের প্রজেক্ট এর চুক্তি করার আগে ডেভেলপার সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নেওয়া উচিত এবং ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওখুব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
লেখক: সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার, স্কয়ার গ্রুপ।