চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আইনজীবীদের তোপের মুখে এজলাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এক বিচারক।
চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত–২ তে এ ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকের নাম মো. অলি উল্লাহ।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার একই আদালতে বিচারকের সাথে আইনজীবীদের তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। এসময় আদালত কক্ষে ব্যাপক হট্টগোল হয়।
এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক এজলাস থেকে নেমে গিয়ে খাস কামরায় চলে যান সংশ্লিষ্ট বিচারক। এরই ধারাবাহিকতায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির অন্যান্য বিচারকরাও এজলাস থেকে নেমে গিয়ে খাস কামরায় চলে যান। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বিচারকরা কর্মবিরতিতে ছিলেন।
এদিকে বিচারকরা এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার পর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–২ এর সামনে আইনজীবীরা সংক্ষুব্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। কর্মসূচি থেকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি–২ এর বিচারক অলি উল্লাহর বদলি চাওয়া হয়।
আদালতসূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেন চলাকালে গত ১৭ জুলাই মুরাদপুরে গুরুতর আহত হয় শোয়েবুল ইসলাম নামের একজন। গতকাল তিনি বাদী হয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–২ এর বিচারক অলি উল্লাহর আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন।
এতে ১২৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। শুনানি শুরু হলে বিচারক বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। বিচারক বাদীকে আসামিদের নাম বলতে বলেন। তিনি কয়েকটি নাম বলেনও। কিন্তু বিচারক আরো নাম বলতে বলেন। যেটি পারেন নি বাদী।
শুনানিতে বাদীর আইনজীবী হিসেবে ছিলেন মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী (রাজ্জাক)। তিনি বর্তমান জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি তাকে জেলা পিপি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে আদালত ভবন ঘেরাও করে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ
প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানান, প্রত্যাশা অনুযায়ী বাদী আসামিদের নাম বলতে না পারায় এবং সার্বিক বিবেচনায় বিচারক মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। যদিও বাদী পক্ষের আবেদন ছিল, মামলাটি এফআইয়ার হিসেবে গ্রহণের জন্য থানাকে নির্দেশ দেওয়া হোক। মূলত এসবকে কেন্দ্র করে তর্কাতর্কি ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে এবং বিচারক এজলাস থেকে নেমে যান।
আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–২ এর বিচারক অলি উল্লাহ এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেসির অন্যান্য বিচারকরাও এজলাস কক্ষ থেকে নেমে গিয়ে কর্মবিরতি পালন করেন। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত চলে দুই ঘণ্টা এ কর্মবিরতি। যদিও এরপর আবারও এজলাসে বসে বিচার কাজ পরিচালনা করেন বিচারকরা। তবে ম্যাজিস্ট্রেট অলি উল্লাহ এজলাসে আর উঠেননি।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পিপি মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী (রাজ্জাক) বলেন, ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে মহানগর দায়রা জজের সাথে আলোচনা হয়েছে। বিচারক অলি উল্লাহ আপাতত বসবেন না। তিনি ছুটিতে থাকবেন। মহানগর দায়রা জজ এ সিদ্ধান্তের কথা আমাদের জানিয়েছেন।
বিচারক অলি উল্লাহর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে উল্লেখ আইনজীবী মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী (রাজ্জাক) বলেন, এর আগে তার বিষয়ে আমরা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, মহানগর দায়রা জজের সিদ্ধান্তের পর আমরা আমাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি স্থগিত করেছি। যদি তিনি আবার এজলাসে বসেন আমরা আবারও তার পদত্যাগ, বদলি চেয়ে আন্দোলনে নামব।
আদালত কক্ষে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে জানতে চাইলে আইনজীবী মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী (রাজ্জাক) বলেন, বাদীর কাছ থেকে সব নাম শুনতে চাইলেন বিচারক। আমি বলেছি, এত নাম বলা সময়ের ব্যাপার। ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের নাম দেওয়া হয়েছে। সব নাম তো বাদী বলতে পারবে না। এরপর বিচারক বলেন, আমার কাজ আমাকে করতে দেন। তারপর তিনি মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন: ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শনে আইন উপদেষ্টা, এড়িয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে প্রশ্ন
যদিও আমাদের আবেদন ছিল, মামলাটি এফআইআর হিসাবে গ্রহণের জন্য থানাকে নির্দেশ দেওয়া হোক। এরপরও আদেশ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। এসময় তিনি বলেন, আমার কোর্টে জোর খাটানোর চেষ্টা করবেন না। তখন আমরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। বলেছি, জোর কোথায় খাটালাম? এরপর তিনি এজলাস থেকে নেমে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চলে যান। এরই ধারাবাহিকতায় ম্যাজিস্ট্রেসির অন্যান্য বিচারকরাও এজলাস থেকে নেমে যান।
এ বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আদেশ পেয়ে বাদীর আইনজীবী কোর্ট থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। এরমধ্যে বিচারক কটূক্তি করে বসলেন। বললেন, এ ধরণের বিষয় নিয়ে তার কোর্টে না যেতে। বিচারক তো এ ধরণের কটূক্তি করতে পারেন না। এর জেরে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেছেন। পরে বিষয়টি নিয়ে মহানগর দায়রা জজের সাথে বসেছেন উল্লেখ করে আইনজীবী মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মহানগর দায়রা জজ বলেছেন, বিচারক অলি উল্লাহ ছুটিতে থাকবেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন বলেন, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অলি উল্লাহর কোর্টে একটি ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে বিচারক কোর্ট থেকে নেমে যান। একই সময় অন্যান্য বিচারকরাও কোর্ট থেকে নেমে যান। কিছুক্ষণ পর অর্থাৎ দুপুর ২ টা, আড়াইটার দিকে বিচারকরা আবার এজলাসে উঠেন। তবে বিচারক অলি উল্লাহ এজলাসে আর উঠেননি। আর কোন কিছু আমার জানা নেই।
ওই ঘটনার জেরে ম্যাজিস্ট্রেটরা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কক্ষে বৈঠকে বসেন। বৈঠক হয় আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথেও। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বার ও বেঞ্চের আলোচনার মাধ্যমে উভয়পক্ষের সম্মতিতে উক্ত বিচারক আদালতে বিচারকাজ পরিচালনা করবেন না।
কিন্তু আজ তিনি আদালতে বিচারকাজ পরিচালনা করতে এজলাসে গেলে আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়েন। পরবর্তীতে এজলাস ছাড়তে বাধ্য হন।