মোকাররামুছ সাকলান: বিগত ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এরই সাথে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অন্যান্য আরো প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়ে নানান প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। মুলত আব্দুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য, ৬৪ ডিএলআর (এডি) পৃষ্ঠা ১৬৯ এর রায়ের মাধ্যমে আপীল বিভাগের ০৭ জন বিচারপতির মাঝে ০৪ জন বিচারপতি সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) ১৯৯৬ (১৯৯৬ এর ১ নং আইন) বাতিল বলে ঘোষণা করেন। অন্য ০৩ জন বিচারপতি সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) ১৯৯৬ (১৯৯৬ এর ১ নং আইন) বৈধ মনে করেন।
সখ্যাগরিষ্ঠ মতের রায় প্রদানকারী, প্রধান বিচারপতি জনাব এ.বি.এম খায়রুল হক সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) ১৯৯৬ (১৯৯৬ এর ১ নং আইন) বাতিল বলে ঘোষণা করলেও Latin Maxim, Id Quod Alias Non Est Licitum, Necessitas Licitum Facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), Salus Populi Est Suprema Lex (Safety of the people is the supreme law) এবং Salus Republicae Est Suprema Lex (Safety of the State is the Supreme Law) ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন।
অর্থাৎ কোন এক অজানা আশংকায় তিনি সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল বললেও তার পক্ষে ছিলেন ফলে এটা সুস্পষ্ট যে প্রধান বিচারপতি জনাব এ.বি.এম খায়রুল হকের রায়ের আইনী যুক্তি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো না। এদিকে বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) ১৯৯৬ (১৯৯৬ এর ১ নং আইন) বাতিল বললেও প্রধান বিচারপতি জনাব এ.বি.এমখায়রুল হকের সাথে যুক্তিগত পার্থক্য ছিলো তবে তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা বিচারপতিগণ হতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ না করার শর্তে পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য বহাল রাখার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহার রায়টিও শক্ত কোন ভিত্তির উপর ছিলো না। বিচারপতি জনাব মোঃ মোজাম্মেল হোসেন কোন পৃথক রায় লিখেন নাই তিনি প্রধান বিচারপতি জনাব এ.বি.এম খায়রুল হকের রায়টির সাথে একমত পোষণ করেন।
এদিকে ভিন্ন ও সংখ্যালঘু মত প্রদানকারী বিচারপতি জনাব মোঃ আব্দুল ওয়াহাব মিঞা ও বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী মনে করেছিলেন যে, সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) ১৯৯৬ (১৯৯৬ এর ১ নং আইন) বৈধ ও একই সাথে বিচারপতি জনাব নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি জনাব মোঃ আব্দুল ওয়াহাব মিঞার সাথে একমত পোষন করেন।
তবে জনাব আব্দুল ওয়াহাব মিঞা, বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলীর রায়ের একটি Findings এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। জনাব আব্দুল ওয়াহাব মিঞা তার রায়ে লিখেছিলেন যে, “যদিও আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা মোহাম্মদ মোহাম্মদ ইমান আলী, জে. এর এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত যে ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ নয় এবং সংবিধানের পরিপন্থীও নয় এবং এটি সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করে না, তবে সম্মানের সাথে বলছি, আমি তাঁর এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত নই যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অনিয়মিত প্রয়োগের কারণে ‘অনুচ্ছেদ৫৮গ(৩), (৪), (৫) এবং (৬) অনুযায়ী’ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে, যার ফলে ২০০৭ সালে একটি অস্বাভাবিক ও অসাংবিধানিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
Though I am in agreement with my learned brother Muhammad Imman Ali, J as to the finding given by him that the Thirteenth Amendment was neither illegal nor ultravires the Constitution and does not destroy any basic structures of the Constitution, but with respect I could not agree with his finding that the Non-Party Care-taker Government system has become unworkable due to the improper exercise of power of the President under “Article 58C(3), (4), (5) and (6) which led to the unnatural and unconstitutional State of affairs in 2007.
ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, আগামী ১৭.১১.২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে Civil Appeal No. 139 of 2005 এবং Civil Petition for Leave to Appeal No.596 of 2005 এর রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (Review) শুনানী হতে যাচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়ে নানান আলোচনার মাঝে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রিভিউ (Review) শুনানী একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়।
রিভিউ (Review) শুনানীতে কি রায় হবে তা আমরা জানিনা তবে বর্তমান সময়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় ভিন্নমত পোষনকারী বিচারক বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী সাহেবের রায়টি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। আজকের এই লেখাটি মুলত বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় কি বলেছিলেন তারই কিছু আলোচনা ও বর্তমান বাস্তবতায় রায়টির প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে দেখা।
ক)। বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির মধ্যে ৪ জন বিচারপতির রায় ও সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। এবং তিনি বলেছিলেন “উপসংহারে, আমি মনে করি যে ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বা সংবিধানের পরিপন্থী নয় এবং এটি সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করে না।”
In conclusion, I find that the Thirteenth Amendment was neither illegal nor ultra vires the Constitution and does not destroy any basic structures of the Constitution.
খ)। তবে ২০০৭ সালের ঘটনাকে স্মরণ করে তিনি লিখেছিলেন “সংবিধানের গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র ত্রয়োদশ সংশোধনীর পর যেমন লঙ্ঘিত হয়নি, তেমনই তা ছিলো এর আগে যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অনিয়মিত প্রয়োগ, বিশেষ করে সংবিধানের ৫৮গ(৩), (৪), (৫) এবং (৬) ধারা অনুযায়ী, এই ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে, যার ফলে ২০০৭ সালে একটি অস্বাভাবিক ও অসাংবিধানিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।”
The Republican and Democratic character of the Constitution was no more infringed after the Thirteenth Amendment than it had been before the Non-Party Care-Taker Government system was introduced. However, the system has become unworkable due to the improper exercise of power of the President under Articles 58 C(3), (4), (5) and (6), which led to the unnatural and unconstitutional state of affairs in 2007.
গ) রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অনিয়মিত প্রয়োগের কথা বলে তিনি এর সমাধানের কথা বলেছেন। তিনি রায়ের লিখেছিলেন “এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন পদ্ধতি, যা-ই নামে এটি অভিহিত হোক না কেন, অন্য একটি পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপিতহওয়া উচিত। জনগণের ক্ষমতার মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে রয়েছে সেই পদ্ধতি পরিবর্তনের অধিকার, যা তাদের সেবা করবে এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করবে। এটি মনে রাখতে হবে যে কোনো পদ্ধতিই কখনোই সম্পূর্ণ নিখুঁত হতে পারে না।”
In order to avoid recurrence of such a situation, the mode of setting up of the interim Government, by whatever name it may be called, is to be replaced by another system. It is fully within the power of the people to change the system which will serve them and sustain their democratic rights. It has to be borne in mind and that no system can ever be foolproof.
ঘ) বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী রায়ের শেষ লাইনে বলছেন “তবুও, যে কোনো নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হোক না কেন, এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে এটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। উপরে আলোচিত হয়েছে যে, জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংসদে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করে।”
Nevertheless, whatever new system is introduced, it will have to be acceptable to the people for it to have durability. As discussed above, the people make their will known by exercising their democratic right through their elected representatives in Parliament.
বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী তার রায়টি হয়তো এই সময়ে প্রাসঙ্গিক কারণ মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ করতে যেয়ে “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশর অন্তর্বর্তী সরকারের” “প্রধান উপদেষ্টা” ও “উপদেষ্টা” শব্দগুলো উল্লেখক রেছিলেন। অর্থাৎ বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী কর্তৃক তার রায়ে ব্যবহৃত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী বলছেন “এই পর্যায়ে, আমি আরও বলতে চাই যে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ শব্দটি এমন একটি অসহায় পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়, যা ১৯৯৬ সালে প্রাসঙ্গিক সময়ে উপযুক্ত ছিল, যখন আমাদের ‘তত্ত্বাবধানের’প্রয়োজনছিল।তবে’নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ শব্দগুচ্ছটি একটি সংসদ বিলুপ্ত হয়ে আরেকটি সংসদ গঠনের মধ্যবর্তীসময়ের জন্য আরও উপযুক্ত বলে মনে হয়।”
At this juncture, I would also suggest that the choice of the words “Care-Taker Government” gives the impression of a helpless situation, which may have been apt at the relevant time in 1996 when we needed the “care”. However, the term “neutral interim Government” would appear to be apposite for the period in between dissolution of one Parliament, to be replaced by another.
এভাবে সার্বিকভাবে দেখা যায় যে, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার আপিল বিভাগের ০৭ জন বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ০৪ জন বিচারপতির রায় ও সিদ্ধান্তে অন্তত দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল ছিলো অন্যদিকে সংখ্যালঘু রায় ও সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ০৩ জন বিচারক সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন।
এই লেখাটি এখানেই শেষ করবো, তবে শেষ করার আগে বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী সাহেবের রায়টির শুরুর কিছু অংশ আপানাদের জানাবো। তিনি তার রায়ে লিখেছিলেন যে, “শুরুতেই, আমি বলতে চাই যে, সৌভাগ্যক্রমে, আমাকে এই মামলার প্রকৃত ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই, কারণ সেগুলো সম্মানিত প্রধান বিচারপতি তাঁর রায়েসংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত প্রদানের সময় অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে বিবৃত করেছেন। সম্মানের সাথে বলছি, এই রায় একটি অনবদ্য রচনা, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য রায় এবং গ্রন্থের বিস্তৃত উল্লেখের মাধ্যমে এই মামলার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অত্যন্ত বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং তা মায়ের ভাষায় অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও, আবারও সম্মানের সাথে বলছি, আমি একমত নই যে বাংলা ভাষায় এই পাণ্ডিত্য দেশের দূর-দূরান্তের মানুষের কাছে পৌঁছাবে, এবং গ্রামের কোনো কুঁড়েঘরে কিংবা শহরের কোনো বাড়িতে বসে থাকা প্রতিটি মানুষ এই রায়পড়তে এবং এর বিষয়বস্তু বুঝতে সক্ষম হবে”
At the outset, I must say that thankfully I need not deal with the factual aspects of this case as those have been dealt with most elaborately by the Hon’ble Chief Justice in his judgment delivering the majority view. With respect, I would say that the judgment is a magnum opus which deals with the matters arising in this case in extreme detail by copious reference to numerous judgements and treatise from various parts of the world, which have been rendered most eruditely in the mother tongue, although, again with respect, I cannot agree that the Bangla erudition will reach the masses in the far-flung corners of the country, and whether every man sitting in his village hut or even townhouse will be able to read and understand the contents thereof .
বর্তমান আপীল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রিভিউ (Review) শুনানীতে যদি বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলীর রায়, যুক্তি ও সিদ্ধান্ত বহাল থাকে তবে হয়ত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতার প্রশ্নটির সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। Hans Kelsenএর Grundnorm তত্ত্বের কঠিন প্রয়োগ হয়তো আর লাগবে না। আইনজ্ঞদের আর De facto বা De jure তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে হবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা প্রশ্নটি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রিভিউ (Review) এর রায়ে সমাধিত হবে সেটাই আশা।
১৭ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রিভিউ (Review) শুনানীর পর যে রায়ই আসুক না কেনো দেশের সাধারণ জনগণ, গ্রামের কোনো কুঁড়েঘরে কিংবা শহরের কোনো বাড়িতে বসে থাকা প্রতিটি মানুষ চাইবে তার প্রাণের দেশে শান্তি বিরাজ করুক। চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হোক দেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রক্রিয়া।
লেখক: মোকাররামুছ সাকলান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।