ড. এম জসিম আলী চৌধুরী ও সিফাত তাসনীম: ১৯৭১ সালের মহানমুক্তি যুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা সংবিধানটি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া হবে নাকি সংশোধন করা হবে সেটি নিয়ে দেশে তুমুল বিতর্ক চলছে। যারা মুল সংবিধান বাতিল করতে চান তাঁদের এক ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও ঝোঁক আছে। মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১ ও সংবিধানের মুলনীতিগুলো নিয়ে নিজ স্বদৃষ্টিভঙ্গি আছে। তাঁদের নানামুখী তৎপরতায় মুল সংবিধান বাতিলের পক্ষে যুক্তি ও ন্যারেটিভ তৈরির কাজ চলছে।
তার বিপরীতে বিপক্ষের বক্তব্যগুলো খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে না। আমরা মনে করি সংবিধানের মতো এত বড় বিতর্কে দুই দিকের কণ্ঠই জোরালোভাবে উচ্চারিত হওয়া অত্যন্ত জরুরী। বুদ্ধিভিত্তিক সততার স্বার্থে আমরা এই নিবন্ধের লেখকদ্বয় প্রথমেই স্বীকার করে নিই যে, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭২ সালের মুল সংবিধান এর প্রতি আমাদের আদর্শিক পক্ষপাত এবং গভীর অনুরাগ আছে। ওই অবস্থান থেকেই আমরা চলমান বিতর্কে অংশ নিতে চাই। তবে নিশ্চিত করতে পারি যে, আমাদের আলোচনায় অনুরাগ-আবেগের উপর যুক্তি প্রাধান্য পাবে।
৫ অগাস্টের পর হতে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভা-সেমিনার, টকশো-তে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিলের পক্ষে যত যুক্তি এসেছে সেগুলো সবগুলোকে আমরা এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছি। যুক্তিগুলো মোটামুটি দুই দাগের। একদিকে ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বেশকিছু “গলদ” এর কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট অনেক “ত্রুটি”র কথা বলা হচ্ছে। তিন পর্বের এ লেখার এই প্রথম পর্বটিতে আমরা সংবিধান প্রণয়নের “গলদ”যেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনা করবো। দ্বিতীয়টিতে আমরাএর “ত্রুটি”গুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তৃতীয়টিতে আমরা তুলে ধরবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি দেশের ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে।
পত্রপত্রিকা ঘেঁটে এযাবৎ আমরা ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” সংক্রান্ত মোটামুটি চারটি যুক্তি খুঁজে পেয়েছি।
প্রথম যুক্তিটি এ রকম – ১৯৭২এর গণ পরিষদের সংবিধান প্রনয়ণের এখতিয়ার প্ৰশ্নবিদ্ধ। ১৯৭০ এ আওয়ামী লীগের নিরংকুশ জয়টা ছিলো পাকিস্তানের নির্বাচনের বিজয়। ওটা দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান লেখা যায় না। তাছাড়া ওই সময় সংবিধানের উপর কোন রেফারেন্ডাম নেয়া হয়নি।
ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে ১৯৭০ এর নির্বাচন কেবল একটি নিয়মিত সংসদীয় নির্বাচন ছিলো না। নির্বাচনটি একটি সুষ্পষ্ট সাংবিধানিক বিতর্কের উপর হয়েছে। ১৯৬৬-র ছয়দফা শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী ছিলোনা।এতে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং বেসামরিক শাসনের রূপরেখাও ছিলো। ছয়দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবীতে সারাদেশে পাঁচ বছরব্যাপী তুমুল রাজনৈতিক অনুশীলন হয়েছে। ১৯৭০ এর মেনিফেস্টোই ছিল ছয় দফা।
নির্বাচনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠী মূলত ছয়দফা-র ভিত্তিতে সংবিধান রচনায় আপত্তি জানিয়েই যুদ্ধ চাপিয়ে দেন। নির্বাচনে বিজয়ী দলের এমপি-রা ছয় দফা ভিত্তিক সংবিধানের প্রতিশ্রুতির উপর অটল থাকার লক্ষ্যে ১৯৭১ এর জানুয়ারিতে রেসকোর্স ময়দানে গণ শপথ করেন।
এরপর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীনতার যেঘোষণাপত্র দেয়া হয় সেটিও একটি সাংবিধানিক দলিল। যুদ্ধশেষ হওয়ার সাথে সাথে ১৯৭২ এর জানুয়ারি মাসের অন্তর্বর্তী সংবিধানও ছিলো একটি সাংবিধানিক রূপরেখা। সংবিধান প্রণেতাদের ১৯৭০ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের পর ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে ১৯৭২ সালে কোন রেফারেন্ডাম হলে সেটিতে সংবিধান প্রণেতারা অনায়াসেই জিততেন। এতে কিছুটা সময় লাগা ছাড়া, অদৌ ভিন্ন কোন ফলাফল কি আসতো?
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত সংবিধান বিশারদ ব্রুস আকারম্যান বলেন, সংবিধান রচনা বা বড়সড় পরিবর্তনের কন্সটিটিউশনাল মোমেন্ট (Constitutional Moment) আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও এজেন্ডা থাকতে হয়।
এ প্রেক্ষিতে আমরা অত্যন্ত আস্থার সাথে দাবী করি যে, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি কন্সটিটিউশনাল মোমেন্ট ছিলো, যেটির জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক বিতর্ক, এজেন্ডা এবং রূপরেখা অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৪ বছর সময়কাল ধরে তৈরি হয়েছে। বিপরীতে বর্তমানে যে সংবিধান লেখার কথা বলা হচ্ছে সেটির রূপরেখা বা এজেন্ডা পরিস্কার নয়।এমনকি দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোও এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত নন।
সংবিধানের সংস্কার হবে নাকি পুনর্লিখন হবে সেটি নিয়েও জাতীয় ঐকমত্য এখনো স্পষ্ট নয়।
দ্বিতীয় যুক্তিটি এরকম – ১৯৭২ এর সংবিধান আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী শাসন কাঠামোর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।
আমরা মনে করি এ বক্তব্যটি অসত্য। পাকিস্তানী স্বৈরশাসক গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের নজিরবিহীন সংবিধান লঙ্ঘন, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত স্বৈরতন্ত্র চালু এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে সংসদীয় গণতন্ত্র হত্যা করার জবাবেই ছয়দফা ও মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। ১৯৭২ এর সংবিধান ছিলো ওয়েস্ট মিনষ্টারে হাজার বছর ধরে চর্চিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও জবাবদিহিমূলক সংসদীয় গণতন্ত্রের আত্নীকরণ যেটির প্রতিশ্রুতি ১৯৫৬ সালের সংবিধানে দেয়া হয়েছিলো। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা সেটিকে মাত্র দুই বছরের মাথায় হত্যা করেন। সুতরাং এটি কোন বিচারেই আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী শাসনযন্ত্রের অনুকরণ নয়।
প্রশ্ন আসতে পারে, সংবিধান প্রণেতাদের ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার মতো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকেই বেছে নিতে হলো কেন। এ প্রশ্নটি ১৯৭২ এর গণপরিষদ বিতর্কেও এসেছে। সংবিধান প্রণেতারা ভারত শাসন আইন ১৯০৯, ১৯১৯ এবং ১৯৩৭ এর ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ১৯৯২ সালে একটি সর্বদলীয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওয়েস্ট মিনস্টার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে আমাদের এদেশে এ ব্যবস্থার উপর একটি জাতীয় ঐকমত্যও হয়ে গেছে।
তৃতীয় যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৭২ এর সংবিধান রচনার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁদের মতামত বিবেচনা করা হয়নি।
আমরা মনেকরি এ যুক্তিটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্ক, সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন, এর উপর জনমত আহ্বান ও এগুলোর বিচার বিবেচনা অনেক বড় পরিসরে হয়েছে। গণপরিষদ বিতর্কের কার্যবিবরণী পড়লে দেখা যায়, সংখ্যালঘু মতের সদস্যরা তাঁদের অনেকগুলো মতামত গৃহীত না হওয়ায় অনুযোগ প্রকাশ করলেও, বিতর্কে তাঁদের অংশগ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর কিছু অংশ নবগঠিত বিরোধী দল জাসদে যোগ দিয়ে সংবিধানের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা সংসদীয় ধাঁচের ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, রাষ্ট্রবিনির্মানের অংশীদার হিসেবে পিপলস আর্মি-র কথা বলেছেন।
তবে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় দেখা যায়,তাঁরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি, সেটি কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন সেটি কখনো স্পষ্ট করেননি। বাংলাদেশের মুল ধারার রাজনিতিতেও জাসদ সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ১৯৭৫ এ রক্তাক্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম অণুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হলেও, এর অব্যবহিত পরেই দলটি প্রাসঙ্গিকতা হারায়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অংশগ্রহণের কোন সংকট যদি থেকে থাকে সেটি সম্ভবত মুসলিম লীগ সহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ নিতে না পারার মধ্যে থাকতে পারে।এটি ১৯৭২ সালের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলেও, ১৯৭৫ এর পর এ দলগুলো রাজনীতিতে পুনঃস্থাপিত হয়।
১৯৭৫ এর পর সংবিধানের মুল নীতি, যেমন ধর্ম নিরপকেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে পরিবর্তন আসে। মুলনীতিগুলো নিয়ে কিছুটা স্তিমিত রাজনৈতিক বিতর্ক এখনো চলমান থাকলেও, ১৯৯২ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি-সহ সব দলের ঐকমত্যের ফলে দেখা যায় মুল সংবিধানের কাঠামোগত ব্যবস্থাটির উপর একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
চতুর্থ যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছে ১৯৭২ সালের সংবিধান এলিট প্রেফারেন্স হিসেবে এসেছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সেখানে ছিলো না। জনগণের উপর এটি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমরা স্বীকার করি “এলিট প্রেফারেন্স” যুক্তিটি একাডেমিক মহলে জনপ্রিয়। ভারতীয় রাজনৈতিক দার্শনিক পার্থ চ্যাটার্জিসহ সাব অল্টার্ন স্টাডিজের স্কলাররা জোর দিয়েইবলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো পলিটিক্যাল এলিটরা নেয়, প্রান্তিক মানুষের সেখানে অংশনেয়ার সুযোগ কম। এ যুক্তিটি তাঁরা দেন মূলত সমাজের ক্ষমতা কাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সম্পদসহ নানাক্ষেত্রে সুযোগের অসমতায় মানুষের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বাধাগুলোর দিকে ইঙ্গিতকরে। এগুলো সামাজিক রূপান্তরের প্রশ্ন।এ ধরণের যুক্তিগুলো দেয়া সহজ, বাস্তবে তেমন ধরণের সমতার সমাজ বিনির্মাণ করে সংবিধান লেখা বা সংস্কার করা অনেকটাই অসম্ভব। সেটি ১৯৭২ সালে যেমন অসম্ভব ছিলো, ২০২৪সালেও তেমনটি আছে।
উল্টো করে বলতে গেলে বর্তমানের সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ যোজন যোজন বেশি প্রতিনিধিত্বমুলক, দেশজ এবং মাটি ঘেঁষা ছিলেন। জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক কথা হচ্ছে, ১৯৭২ এ সংবিধানের উপর আলাপ আলোচনাও এতে অংশ নেয়ার সুযোগ সাধারণভাবে আগ্রহী যে কারো জন্য উম্মুক্ত ছিলো কিনা। এর একেবারে ঐতিহাসিক সত্য উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ।
স্পষ্টতই ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” সংক্রান্ত উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো যতটা না বুদ্ধিভিত্তিক সততা থেকে তোলা হচ্ছে সম্ভবত তার চেয়ে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের উপর গড়ে উঠা ১৯৭২ এর গণপরিষদে মূল সংবিধান প্রণেতাদের সংবিধান লেখার অধিকার ও প্রক্রিয়াকে প্রচ্ছন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে তোলা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এ লেখার পরের পর্বে আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানের যে “ত্রুটি”গুলো সনাক্ত করা হয়েছে সেগুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
লেখক: ড. এম জসিম আলী চৌধুরী, প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য এবং সিফাত তাসনীম, আইন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি।