নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধানের 'গলদ'
ড. এম জসিম আলী চৌধুরী ও সিফাত তাসনীম

নতুন সংবিধান বিতর্ক: সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্বের প্রশ্ন

(প্রথম পর্ব নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” ও দ্বিতীয় পর্ব নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি” হতে চলমান)

ড এম জসিম আলী চৌধুরী ও সিফাত তাসনীম: ৫ অগাস্টের পর হতে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভা-সেমিনার, টক শো-তে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিলের পক্ষে যত যুক্তি এসেছে সেগুলো সবগুলোকে আমরা এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছি। যুক্তিগুলো মোটামুটি দুই দাগের। একদিকে ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বেশ কিছু “গলদ” এর কথা বলা হচ্ছে।

অন্যদিকে ১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট অনেক “ত্রুটি”র কথা বলা হচ্ছে। তিন পর্বের এ লেখার প্রথম পর্বে আমরা সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” যেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনা করেছি। দ্বিতীয় পর্বে আমরা “ত্রুটি” গুলো উপস্থাপন করে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এই তৃতীয়  ও শেষ পর্বটিতে আমরা তুলে ধরবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি দেশের ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে।

প্রথমত, ১৯৭২ এর সংবিধানের অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু এটির সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, এটির স্ট্রাকচারাল ডিজাইন (কাঠামোগত বিন্যাস) যেটি বেশ শক্তিশালী এবং যার জোরে এটি ৫৩ বছর ধরে হত্যা, ক্যু, সেনাশাসন ও চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং কাজের-অকাজের সংশোধনের ঝড়-ঝাপ্টা সয়ে টিকে গেছে। তুলনামূলক সংবিধানের ইতিহাসে এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, সংবিধান বাতিল করা বা নতুন সংবিধান নেয়ার সংখ্যায় এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোই কম স্থিতিশীল হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সংবিধান ১৯৫৬, ১৯৬২ এবং ১৯৭৩ সালে তিনবার নতুন করে লেখা হয়েছে। আফগানিস্তানের সংবিধানও তিনবার নতুন করে লেখা হয়েছে – ১৯২৩, ১৯৬৪ এবং ২০০৪ এ। শ্রীলংকায় ১৯৭২ এবং ১৯৭৮ সালে দুটি সংবিধান লেখা হয়।মায়ানমারে ১৯৪৭, ১৯৭৪ এবং ২০০৮এ সংবিধান লেখা হয়েছে। দেশটিতে ১৯৮৮ হতে ২০০৮ সময়কালে কোন সংবিধানই ছিলো না।

এ চারটি দেশের কোনটিই সাংবিধানিকতার জন্য সুপ্রসিদ্ধ নয়। পাকিস্তান সেনা শাসনের গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি। আফগানিস্তানের ২০০৪ সালের সংবিধানটি ২০২১ সালে তালেবান সরকার ছুঁড়ে ফেলেছে। দেশটিতে এখন সংবিধান বলে কোন দলিল নেই। প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন ও তামিল-সিংহলবিরোধের জেরে শ্রীলংকার ১৯৭২ এর সংসদীয় সংবিধান ফেলে দিয়ে ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত সংবিধান নেয়া হয়। এরপর পরই দেশটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মুখে পরে। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ক্রমাগত টানাপড়েনে এর সাংবিধানিক কাঠামো ভঙ্গুরই থেকে গেছে। মায়ানমার সম্ভবত সংবিধানহীন সেনা ও জাতিগত নৈরাজ্যের ভয়াবহতম উদাহরণ।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালে এসে সময় ও সুযোগের জোরে নূতন সংবিধান লেখার সংস্কৃতি চালু হয়ে গেলে সেটি ভবিষ্যতেবারবার নতুন করে লেখার পথ খুলে দিতে পারে। আগের পর্বগুলোতে আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট হিসাব নিকাশ না করে বা না দিয়ে ঢালাওভাবে সংবিধান নতুন করে লিখতে বলার জিগিরটা ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের উপর গড়ে উঠা ১৯৭২ এর গণপরিষদ এবং মূল সংবিধান প্রণেতাদের প্রতি, তাঁদের সংবিধান লেখার অধিকার এবং মূল্যবোধজনিত অবস্থানগুলোর প্রতি একধরণের হিংসা, আক্রোশবাবিতৃষ্ণাতাড়িতবলে প্রতীয়মান হতে পারে।

সেক্ষেত্রে আলোচ্য “নতুন সংবিধান” দীর্ঘমেয়াদে অস্ত্বিত্বের সংকটে পড়তে পারে। পরে আর কেউ সংবিধান সংশোধনের মতো জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ পথে যাবেন না। সংশোধন করলে আদালতে ব্যাসিক স্ট্রাকচারের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।তারচেয়ে বরং নতুন সংবিধান লিখে নিয়ে আদালতের বিচারকদেরকেই বলা যায়, এই নতুন সংবিধানটা মানার শপথ নিন।

দ্বিতীয়ত, অনেকে দাবি করছেন, সংবিধান সংশোধন করে মৌলিক কোন পরিবর্তন আনা যাবেনা। কারণ আমাদের আদালতের ব্যাসিক স্ট্রাকচার নীতির কারণে পরবর্তীতে এ সংশোধনীকে বাতিল করে দেয়ার সুযোগ থাকবে।

আমরা মনে করি এ যুক্তিটি অগভীর। আমাদের কাছে এটা বোধগম্য নয়, বর্তমানের সংস্কার প্রস্তাবের ভেতর এমন কি কি আছে যেগুলো ১৯৭২ এর সংবিধানের ব্যাসিক স্ট্রাকচারের পরিপন্থী হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষত আগের দুই পর্বের আলোচনায় যে সুনির্দিষ্ট ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলোর জন্য যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোর কোনটিই ১৯৭২ এর সংবিধানের একেবারে প্রধানতম মৌলিক কাঠামো “গণতন্ত্রে”র সাথে সংঘাতপূর্ণ নয়। আদালতের রায় মতেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা ১৯৭২ এর সংবিধানের ব্যাসিক স্ট্রাকচার। এগুলোর কোনটিই ১৯৭২ এর সংবিধানের ত্রুটি নয়, বরং শক্তি।

অনেকে বলছেন দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করতে গেলে (যেটি ভালো প্রস্তাব) বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা করতে গেলে (যেটি উপরের দ্বিতীয় পর্বের সপ্তম যুক্তিতে বলা কারণে বিপদজনক) হয়তো আমাদের আদালত সেগুলোকে ব্যাসিক স্ট্রাকচারের দোহাই দিয়ে বাতিল করে দেবেন। যুক্তিটি যথেষ্ট শক্ত নয়। কারণ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যে গণভোটের বিধান ছিলো সেটি পুনরুজ্জীবিত হলে এবং গণভোটের মাধ্যমে এ সংশোধনীগুলো নির্বাচিত সরকার গ্রহণ করে নিলে আদালতের ব্যাসিক স্ট্রাকচার তত্ত্ব দিয়ে এগুলোকে বাতিল করার সুযোগ থাকে না।

ব্যাসিক স্ট্রাকচার তত্ত্বটি আদালত নানা সময় নানা ভাবে বলেন এটি সত্য। কিন্তু জনগণের অংশগ্রহণে সম্পাদিত কোন সংশোধনীকে বাতিল করার নজির আমাদের দেশে নেই। বিখ্যাত আনোয়ার হোসেন মামলায় বরং বিচারপতি হাবিবুর রহমান ইঙ্গিত করেছিলেন, ৮ম সংশোধনী রেফারেন্ডামের মাধ্যমে হলে, ওই মামলার ফলাফল অন্য রকম হতো। ব্যাসিক স্ট্রাকচার তত্ত্বের প্রায়োগিক সমস্যার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান নিলে আদালত সেটিরও ব্যাসিক স্ট্রাকচার খুঁজবেন।

তৃতীয় একটি যুক্তি হতে পারে বর্তমান সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছদের অসংশোধন যোগ্যতার বিধানের কারণে এটি সংশোধন করা যাবে না। এটির উত্তর হচ্ছে, ৭খ অনুচ্ছেদকেই ব্যাসিক স্ট্রাকচার পরিপন্থী বলে চ্যালেঞ্জ করে বাতিল করানোর সুযোগ আছে। সেটি না করে সংবিধানকেই বাতিল করে দিতে গেলে বরং পরে ৭ক অনুচ্ছেদ (রাষ্ট্র দ্রোহ)-র অভিযোগ সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমান সংবিধানের সঙ্কটকে এর মুখোমুখী হয়েই মোকাবেলা করাটা সবচেয়ে ভালো কৌশল। সংবিধান থেকে বেরিয়ে গিয়ে এ সমস্যাগুলো সমধান করতে গেলে আরো অনেক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

চতুর্থ যুক্তিটি বেশ বিপ্লবী ধাঁচের। বলা হচ্ছে সংবিধানের খোলনলচে পাল্টাতে হলে সংশোধন ক্ষমতায় (Amendment Power) হবে না, সংবিধান লেখার ক্ষমতা (Constituent Power) দিয়ে কাজটা করতে হবে।যুক্তিটি প্রকৃত আইনজ্ঞদের চেয়ে বাম ঘরানার কবি সাহিত্যিকরাই বেশি দিচ্ছেন। তুলনামূলক সংবিধানের গবেষণায় কনস্টিটিউশনাল রিনিউয়াল, ডিজমেম্বারমেন্ট এবং রেভলিউশনারী কনস্টিটিউশনালিজম নিয়ে অনেক লেখালেখি আছে। এগুলোর মুল কথা হচ্ছে, কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ার (জনগণের সংবিধান লেখার ক্ষমতা) সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেও চর্চা করা যায়। প্রতিটি মৌলিক ও বড় পরিবর্তনের জন্য সংবিধান নতুন করে লেখা অবশ্যক নয়। সবসময় নতুন সংবিধান লেখা ভালো কৌশলও নয়।

সংবিধান ঘন ঘন বদলালে এর দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার সক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। সংবিধান ধারাবাহিক এবং দীর্ঘায়ু হলেই বেশি টিকে। ওই সংবিধানগুলো নিখুঁত না হলেও, খারাপ সংশোধন ঠেকাতে না পারলেও তাঁদের একটা ইন্টারনালরেজিলিয়েন্স, প্রতিষ্ঠিত জুরিস্প্রুডেন্স এর শেকড় থাকে। ওই রেজিলিয়েন্স ও শেকড়ের জোরেই আমরা বলতে পারি ওই ওই সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী, ওগুলো বাতিল করতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভেদে কোন অগণতান্ত্রিক সংশোধনী তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ করা না গেলেও (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল), সময়ের বিচারে এগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে বাধ্য। কোন কোন সংশোধনী কখনো চ্যালেঞ্জ করা না হলেও (যেমন চতুর্থ সংশোধনী) সংবিধানের রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় ওগুলো হারিয়ে যেতে বাধ্য। প্রয়োজন শুধু সংবিধানকে টিকে থাকতে দেয়া এবং শেকড় গজাতে দেয়া। শেকড় সহ প্রাচীন অশ্বথ উপড়ে ফেলে নতুন চারা গাছ লাগিয়ে না ঐতিহ্য রক্ষা করা যায়, না সবুজ।

আমাদের দেশে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বলতে গেলে একটা নতুন সংবিধান লেখা হলেও ওই সংশোধনীর উদ্যোক্তারা সেটিকে নতুন করে লেখা বলেননি। সংশোধন বলেছেন। ১৯৭৬-৭৯ সাল পর্যন্ত জিয়ার করা সাংবিধানিক সংস্কারগুলো বলতে গেলে ১৯৭২ এর সংবিধান এবং ১৯৭৫ এর সংশোধনীর চেহারাই পাল্টে দেয়। ওটাও বলতে গেলে এক ধরণের “নতুন করে সংবিধান লেখা”। তারপরও জিয়া এবং তাঁর দল এটাকে সংশোধন বলেছেন। নতুন সংবিধান বলেননি। ১৯৯২ সালের ১২-তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারে ফেরত যায়। প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল এটাকে একটা “সংবিধানের চক্রপূরণ” বলে আখ্যায়িত করেন। ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১২-তম সংশোধনী রাষ্ট্র কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনে।তারপরও দেশের কোন রাজনৈতিক দল সংবিধান নতুন করে লেখার কথা দাবি করেননি। তাঁরা সংশোধনের কথাই বলেছেন। ২০১১ সালের ১৫-তম সংশোধনীও আরেকটি বিরাটকায় কাঠামোগত ও আদর্শিক পরিবর্তন। সেবারও কেউ নতুন করে লেখার কথা বলেননি।

আমরা বিশ্বাস করি, এসব ঘটনা পরম্পরা কেবল ঐতিহাসিক কাকতাল নয়। পরিবর্তনের প্রতিটি বাঁকেই পরিবর্তনের উদ্যোক্তারা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্বের গুরত্বকে অস্বীকার করতে পারেন নি। ওই কন্সটিটিশনাল কনজারভেটিজমের জোরেই হয়তো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বার বার নিজের আত্নপরিচয় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা বা মায়ানমারের চেয়ে আলাদা থাকে।

লেখক: ড. এম জসিম আলী চৌধুরী, প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য  এবং সিফাত তাসনীম, আইন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি।