আদালতবিমুখ আওয়ামী লীগ সমর্থিত শীর্ষ আইনজীবী নেতারা
আইনজীবী (প্রতীকী ছবি)

আদালতবিমুখ আওয়ামী লীগ সমর্থিত শীর্ষ আইনজীবী নেতারা

হামলা-গ্রেপ্তার এড়ানোর লক্ষ্য

হামলা ও গ্রেপ্তার এড়াতেই আদালতমুখী হচ্ছেন না আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক শীর্ষ আইনজীবী নেতা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের সর্বোচ্চ ও অধস্তন আদালতে এমন চিত্র দেখা গেছে।

অনেক আইনজীবী নেতার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে হত্যা মামলা। এসব মামলায় কারো কারো নাম থাকলেও অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে শত শত। ফলে কে কখন কোন মামলায় গ্রেপ্তার হন সেটা এড়াতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত শীর্ষ আইনজীবী নেতাদের অনেকেই রয়েছেন আত্মগোপনে।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সন্তোষজনক মনে না হওয়ায় আইনজীবী নেতারা আদালতমুখী হচ্ছেন না। অনেকের মনে শঙ্কা যে দায়েরকৃত এসব হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। আবার আদালতে এলে হামলা হতে পারে। সেজন্য এক ধরনের শঙ্কা থেকেই আইনজীবী অনেক নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আদালতে আসছেন না বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন, সাবেক এমপি ও মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির, সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক ও অ্যাডভোকেট আবদুন নূর দুলাল, সাবেক এমপি সানজীদা খানম, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পিপি আবু আব্দুল্লাহ, অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাদল, অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল প্রমুখ।

এই আইনজীবী নেতারাই গত দেড় দশকে দাপটের সঙ্গে আদালতে মামলা পরিচালনা করেছেন। অসংখ্য বিচারপ্রার্থী মানুষকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন দেড় হাজারের অধিক শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আর ২৩ হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। ফলে এক ধরনের ক্ষোভ থেকেই আইনজীবী নেতারা ‘মব জাস্টিসের’ শিকার হতে পারেন বলে জানান সাধারণ আইনজীবীরা।

সাধারণ আইনজীবীরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিগত তিনটি নির্বাচন করা হয়েছে একতরফাভাবে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত শীর্ষ আইনজীবী নেতাদের ইন্ধনে এ ধরনের নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী মতাদর্শের আইনজীবী প্যানেলের প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে পুলিশ প্রহরায় একতরফা ভোট করা হয়।

এমনকি এ ধরনের ভোটের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা ও মারধরের শিকার হন বিএনপিপন্থি প্যানেলের শীর্ষ আইনজীবী নেতা ও প্রার্থীসহ সাধারণ আইনজীবীরা। ফলে ঐ তিনটি নির্বাচন আয়োজন নিয়েও আওয়ামীপন্থি আইনজীবী নেতাদের ওপর এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে আইনজীবীদের। ফলে আওয়ামীপন্থি শীর্ষ আইনজীবী নেতারা আদালতমুখী হলে তাদের ওপর হামলা করতে পারে এমন আশঙ্কাও কাজ করছে অনেকের মনে।

শুধু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নয়, ঢাকা আইনজীবী সমিতির বিগত কয়েকটি নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতারা।

এদিকে গত ৫ আগস্টের পর হত্যা মামলায় আওয়ামীপন্থি আইনজীবী নেতাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন ও অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাছান চৌধুরী, সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তবে আওয়ামীপন্থি অনেক আইনজীবী নেতা আদালতে আসছেন এবং মামলা পরিচালনাও করছেন।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, অনেকের নামে সুনির্দিষ্ট মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কী পরিণতি হতে পারে সেটা ভেবেই হয়তো শীর্ষ আইনজীবী নেতারা কোর্টে আসছেন না। হয়তো এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতাও কাজ করছে।

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পন্থায় একটা দল যাবে, আরেকটি দল আসবে। কিন্তু অতীতে আইনজীবী সমিতিতে ঐতিহ্য ছিল যে কোনো সংকটে সিনিয়র আইনজীবীদের ভূমিকা রাখা সেটা এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। আমি মনে করি এখন বারে কাজের পরিবেশ নেই। এটা পুরো আইনজীবী সমাজেরই ব্যর্থতা।

তবে বিএনপিন্থি আইনজীবী নেতা ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র আইনজীবী যারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তারাই মূলত কোর্টে আসছেন না। এছাড়া ফ্যাসিবাদ-উত্তর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে ক্ষোভ সেই ক্ষোভের মুখোমুখি হতে চান না বলেই হয়তো নিজ দায়িত্বে উনারা কোর্টকে এড়িয়ে চলছেন। এছাড়া গত ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দুই বার সুপ্রিম কোর্টে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেছেন। এই বিষয়টিও আইনজীবীদের না আসার কারণ হতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন আইনজীবী নেতা বলেন, আইন পেশায় এ ধরনের পরিস্থিতি অতীতে দেখা যায়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় তো বিএনপি ও আওয়ামীপন্থি শীর্ষ আইনজীবী নেতারা কোর্টে গিয়েছেন এবং মামলা পরিচালনা করেছেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেন এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো সেটা আইনজীবী নেতাদের উপলব্ধির সময় এসেছে।

সূত্র: ইত্তেফাক